বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডা গেলো রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর পরিবার
2022.04.01
ঢাকা ও কক্সবাজার

কক্সবাজার উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হওয়ার ছয় মাস পর বাংলাদেশ ছাড়লেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ১১ সদস্য।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে বৃহস্পতিবার রাতে তাঁরা কানাডার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন বলে সরকারের একাধিক সূত্র বেনারকে নিশ্চিত করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) মিয়া মো. মাইনুল কবির শুক্রবার বেনারকে বলেন, “এক্ষেত্রে মুহিব উল্লাহর পরিবারের আবেদনের চেয়ে কানাডা সরকারের আগ্রহকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ।”
এই পরিবারটির দেশ ছাড়ার বিষয়ে আশ্রয়দানকারী দেশ হিসেবে কানাডাই সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে দাবি করে এই কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগকে অবহিত করা ছাড়া বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আর কিছুই করেনি।
দেশ ছাড়ার আগে মুহিবের স্বজনদের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা জানিয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “শনিবার তাঁদের কানাডায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।”
কানাডাগামী ১১ জনের মধ্যে মুহিবের স্ত্রী নাসিমা খাতুন, নয় ছেলেমেয়ে ছাড়াও এক মেয়ের জামাই রয়েছেন বলেও জানান নূর খান।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সহযোগিতায় কানাডার সরকারি কর্মসূচির আওতায় ‘শরণার্থী’ মর্যাদা দিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
নিরাপত্তাহীনতা ছিল
নিজের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) কার্যালয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মুহিব নিহত হওয়ার থেকেই তাঁর এই স্বজনরা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ছিলেন জানিয়ে নূর খান বলেন, “নিরাপদ জীবনের আশায় তাঁরা কানাডায় গেছেন।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউএনএইচসিআর-এর ঢাকাস্থ কর্মকর্তা মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বেনারকে বলেন, “ইউএনএইচসিআর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করে না।”
এ ব্যাপারে ইমেইল করে আইওএম বাংলাদেশ, কানাডারা অভিবাসন, শরণার্থী ও নাগরিকত্ব বিভাগ এবং ঢাকার কানাডিয়ান হাইকমিশন থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ও।
মুহিব উল্লাহ খুন হবার পর নিরাপত্তা বিবেচনায় তাঁর পরিবারকে ১৩ অক্টোবর এবং পরদিন তাঁর সংগঠনের আরো ১০ নেতার পরিবারকে ক্যাম্প থেকে নিরাপদ স্থান সরিয়ে নেয়া হয় বলে জানান কক্সবাজারের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন কর্মকর্তারা।
তৃতীয় দেশে যেতে চায় আরো কয়েকটি পরিবার
মুহিব উল্লাহ ও অন্যান্যদের পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেওয়ার পর নিহত মুহিবের ভাগ্নে ও তাঁর সংগঠন এআরএসপিএইচ মুখপাত্র রশিদ উল্লাহ বেনারকে বলেছিলেন, জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে না থেকে কোনো ‘থার্ড কান্ট্রিতে’ যেতে চাইছে এই ১১টি পরিবার।
সর্বশেষ শুক্রবার বেনারকে তিনি বলেন মুহিব উল্লাহর পরিবারের ওই সদস্যদের সম্প্রতি উখিয়া থেকে, “চিকিৎসার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জানতে পারি তাঁদের কানাডা পাঠানো হচ্ছে।”
“এটি তাঁদের জন্য অনেক ভালো হয়েছে। তবে আমরা যারা মুহিব উল্লাহর কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত, তারা সবাই আসলে নিরাপত্তাহীনতায় আছি,” বলেন তিনি।
আরেক এআরএসপিএইচ সংগঠন আব্দুর রহিমেরও একই ভাষ্য। তিনি বেনারকে বলেন, “আমরাও তৃতীয় দেশে যাওয়ার আবেদন করেছিলাম। কারণ, ক্যাম্পে আমাদের জীবনের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে।”
এভাবে কোনো দেশের পক্ষ থেকে আর কাউকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মাইনুল বলেন, “মুহিব উল্লাহর পরিবারের বিষয়টি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা।”
এর আগে ২০০৯-১০ সালে ৯২৬ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছিল বলে বেনারকে জানান অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর।
তবে কিছু রোহিঙ্গাকে অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরের সেই প্রেক্ষাপট আর মুহিব উল্লাহর ঘনিষ্ঠজনদের কানাডায় পাঠানোর পটভূমি কিন্তু “এক নয়,” জানিয়ে নূর খান লিটন বলেন, মুহিব উল্লাহর পরিবার সদস্যরা বাংলাদেশে “অনিরাপদ ছিলেন।”
দেশ ছাড়ার আগে স্বজনরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুহিবের প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বলেও বেনারকে জানান তাদের এই পারিবারিক বন্ধু।
তিনি বলেন, “মিয়ানমারের পাঠক্রমে পরিচালিত স্কুলটি কিছুদিন আগে বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।”
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাত করে আলোচনায় আসা মুহিব উল্লাহ মিয়ানমারের মংডুতে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন বলে রোহিঙ্গাদের কাছে ‘মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
মুহিব হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত জড়িত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন। তিনি বলেন, “এর মধ্য চারজন আসামি বিচারিক আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে।”