নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহর পরিবারের দাবি, হুমকি দেয়া হচ্ছে তাঁদের
2021.10.06
ঢাকা ও কক্সবাজার

শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করার পর থেকে তাঁর ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ, স্ত্রী নাসিমা খাতুনসহ অন্যান্য আত্মীয়–স্বজনদের অপরিচিত নম্বর থেকে মোবাইলে টেক্সট ও ভয়েজ মেসেজ পাঠিয়ে প্রতিনিয়ত হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নিহত আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহর (৫০) চাচা ও ভাগিনা বেনারের সাথে আলাপকালে জানান, অপরিচিত নম্বর থেকে আসা এসব মেসেজে এই হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নিতে এবং বিষয়টি নিয়ে বেশি কথা না বলতে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
অপরদিকে পুলিশ বলছে, এসব হুমকির ঘটনা কেন এবং কারা ঘটাচ্ছে তা নিয়েও কাজ করছেন মামলাটির তদন্তকারীরা।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন মুহিব উল্লাহ।
মুহিব উল্লাহর চাচা মো. সৈয়দ আলম (৬৪) বেনারকে বলেন, “মামলা করার পর থেকে মামলা তুলে নিতে মুহিবের স্ত্রী নাসিমা খাতুন, ভাই হাবিব উল্লাহকে প্রতিনিয়ত হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অজ্ঞাত নম্বর থেকে ম্যাসেজ, ভয়েস ম্যাসেজ পাঠিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে সন্ত্রাসীরা।”
“শুধু স্ত্রী ও ভাই নয়, আত্মীয়–স্বজনদের মধ্যে যারা বিষয়টি নিয়ে ভাবছে সবাই হুমকি পাচ্ছে। এই অবস্থায় মুহিব উল্লাহর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনেরা প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারছেন না,” যোগ করেন আলম।
মঙ্গলবার দুপুরে বেনার প্রতিবেদক উখিয়ার লম্বাশিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল ও মুহিব উল্লাহর বাড়িতে দেখতে পান, ঘর এবং সংগঠনের কার্যালয়ের সামনে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সদস্যরা পাহারা বসিয়েছেন।
এ সময় এ প্রতিবেদক মুহিবের স্ত্রী নাসিমা বেগম ও ভাই হাবিব উল্লাহর সাথে কথা বলতে চাইলে তাঁরা ঘর থেকে বের হননি।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিয়ে মুহিব উল্লাহর ভাগিনা এবং এআরএসপিএইচ’র মুখপাত্র মো. রশিদ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “আমরা খুব ভয়ের মধ্যে দিন পার করছি। এই খুনের ঘটনায় মামলা হবার পর থেকে একের পর এক হুমকি আসছে।”
হাবিব উল্লাহ ও নাসিমা গণমাধ্যমের সাথে কথা বলায় ঝুঁকি আরও বেড়েছে জানিয়ে রশিদ বলেন, এজন্য তারা আর মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চায় না।
এআরএসপিএইচ’র সাধারণ সম্পাদক মো. জুবায়ের বেনারকে বলেন, সংগঠনের চেয়ারম্যানকে এভাবে গুলি করে হত্যার ঘটনায় অন্যরা সবাই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।
“হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পার হলেও ক্যাম্পের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। এখনও বুঝতে পারছি না, সংগঠনের কার্যক্রম আদৌ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কিনা,” যোগ করেন জুবায়ের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর পুলিশ সুপার মো. নাঈমুল হক বেনারকে বলেন, “মুহিব উল্লাহর পরিবারকে হুমকি প্রদানের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে এ ধরনের বেশকিছু ম্যাসেজ সংগ্রহ করা হয়েছে।”
“কারা, কী উদ্দেশ্যে হুমকি দিচ্ছে, কোথা থেকে দিচ্ছে–এসব বিষয় নিয়ে মামলাটি যারা তদন্ত করছেন, তাঁরা কাজ করছেন। অনেক সময় ভুয়া ম্যাসেজও দেওয়া হয়,” বলেন নাইমুল।
এদিকে বুধবার কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মুহিব উল্লাহ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার আরও তিন আসামির প্রত্যেকের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
একই মামলায় এর আগে গ্রেপ্তার আরও দুই আসামিকে তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন মুহিব উল্লাহ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বুধবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, সরকার মুহিব উল্লাহ’র হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
“আমরা এই ঘটনার পর তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা কোথাও এ ধরনের ঘটনা চাই না। মুহিব উল্লাহ রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন,” যোগ করেন মোমেন।
তিনি আরো বলেন, “কেউ কেউ রাখাইনে নিজ ভূমিতে ফিরে যাবার জন্য মুহিব উল্লাহর আগ্রহকে পছন্দ নাও করে থাকতে পারে। তার খুনিরা পার পাবে না এবং অবশ্যই তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।”
সহিংসতায় চার বছরে ১০৮ রোহিঙ্গার মৃত্যু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সংগঠন বাংলাদেশ পিস অবজারভেটর (বিপিও) এর হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত শরণার্থী রোহিঙ্গা শিবিরে বিভিন্নভাবে খুন হয়েছেন কমপক্ষে ২২৮জন রোহিঙ্গা।
বিপিও’র রিসার্চ ম্যানেজার মো: হুমায়ুন কবির বেনারকে বলেন, খুন হওয়াদের মধ্যে নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে মারা গেছেন ১০৮ জন এবং বাকিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধসহ’ নানাভাবে মারা গেছেন।
তিনি আরো জানান, এই সময়কালে কমপক্ষে ৩৭৩জন রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে এই ডাটা বিপিও সংরক্ষণ করেছে বলে জানান তিনি।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে গত কয়েক বছরের সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে বলে বেনারকে জানান সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ।
তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপ ও সংগঠনে ভাঙন বেড়েছে। নানা কারণে নিজেদের প্রতি বিশ্বাসও কমেছে একে অপরের। এসব কারণে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ লড়াইটা বেড়েছে।”
এদিকে, বুধবার এক বিবৃতিতে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হুমকি ও সহিংসতার মুখোমুখি শরণার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা (এইচআরডব্লিউ)।
বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা নেতৃবৃন্দ এবং ক্যাম্পে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবীরা এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছেন, ক্যাম্পে সশস্ত্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে এবং চাঁদাবাজিসহ অন্য অপরাধের টার্গেট হচ্ছেন তাঁরা।
এতে বলা হয়, মুহিব উল্লাহ খুন হবার এক মাস আগে থেকেই বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের কাছে থকে হুমকি পেয়ে আসছিলেন।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে কক্সবাজার থেকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আব্দুর রহমান।