দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট: দেশগুলোর মহাকাশ ও টেলিযোগাযোগে নতুন দিগন্ত
2017.05.05
ঢাকা

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মহাকাশের পথে উৎক্ষেপণ করা হলো বহুল আলোচিত দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট। এর সঙ্গে যুক্ত হলো বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। যদিও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জের ধরে এতে অংশ নেয়নি পাকিস্তান।
এই স্যাটেলাইটটির মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশ ও টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। স্যাটেলাইটটি ব্যবহার করে বাংলাদেশও বিশেষ সুবিধা পাবে বলে মনে করছে তাঁরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বেনারকে জানান, “দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তযোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া দুর্যোগ পরিস্থিতিতে জরুরি যোগাযোগসহ বাংলাদেশ টেলিভিশন ব্রডকাস্ট, ডিটিএইচ টেলিভিশন সেবায় বিশেষ সুবিধা নিতে পারবে।”
আসছে ডিসেম্বরে নিজেদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে সে কাজ কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হবে না নিশ্চিত হওয়ার পরেই বাংলাদেশ সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইটে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
“বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি বসবে ১৯০ ডিগ্রি অন্যদিকে। অর্থাৎ কাভারেজ এলাকা ভিন্ন। কাজেই সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এটা অনেক কাজে আসবে,” বেনারকে বলেন বিটিআরসি সচিব সরওয়ার আলম।
স্যাটেলাইটটি পানি সংরক্ষণ উদ্যোগ, আবহাওয়া বার্তা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সতর্ক বার্তা পাঠানোসহ রেডিও-টেলিভিশনকে সাপোর্ট দেওয়ার কাজে আসবে জানিয়ে বিটিআরসি সচিব জানান, “তবে এর উপকারিতা নির্ভর করবে আমাদের ব্যবহারের ওপর।”
শুক্রবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন-ইসরোর তৈরি করা জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটটি শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও ভারতের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অনুষ্ঠানে সূচনা ও সমাপনী বক্তৃতা দেন।
এই কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি ইউএস ডলার, যা পুরোপুরি ভারত সরকার বহন করছে। সাউথ এশিয়া স্যাটেলাইটে ১২টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। বাংলাদেশ এর মধ্যে একটি ট্রান্সপন্ডার বিনা মূল্যে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করার সুযোগ পাবে।
প্রসঙ্গত, ট্রান্সপন্ডার স্যাটেলাইটে সংযুক্ত একেকটি ডিভাইস, যা বেতার তরঙ্গ রিসিভার, স্বয়ংক্রিয় ফ্রিকোয়েন্সি কনভার্টার এবং ট্রান্সমিটার হিসাবে কাজ করে।
বাংলাদেশের প্রথম নিজস্ব ক্ষুদ্রাকৃতির কৃত্রিম উপগ্রহ প্রকল্পের প্রধান ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খলিলুর রহমান বেনারকে বলেন, “ওপেন স্পেসে (মহাকাশে) কেউ যদি আমাদের কিছু দেয়, সেটা ভীষণ ইতিবাচক। স্যাটেলাইটটির মাধ্যমে যত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে, এর প্রায় আট শতাংশ সুবিধা বিনা মূল্যে নিতে পারবে বাংলাদেশ। এটা অত্যন্ত ভালো খবর।”
তবে এ বিষয়ে দ্বিমত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম. মোস্তফা আল মামুন বেনারকে বলেন, “এর মাধ্যমে যে অনেক বেশি সুবিধা পাব, তা নয়। ইতিমধ্যে আমরা অন্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কাজ করছি। ফ্রি দিলেও কতটুকু ব্যান্ডউইথ ভারত দিচ্ছে, তার ওপরে নির্ভর করবে অনেক কিছু।”
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে সার্ক সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশকে নিজেদের নির্মাণ করা এই উপগ্রহে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান নরেন্দ্র মোদি। পাকিস্তান ছাড়া বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের সকল দেশ এ আহ্বানে সাড়া দেয়।
বাংলাদেশের সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসের তথ্যমতে, পাকিস্তান এ স্যাটেলাইট বানানোর কাজে বিজ্ঞানী এবং অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সে সহযোগিতা নিতে ভারত অস্বীকৃতি জানানোয় সরে দাঁড়ায় পাকিস্তান। ফলে শুরুতে এর নাম সার্ক স্যাটেলাইট রাখা হলেও পাকিস্তান যোগ না দেওয়ায় এর নাম পরিবর্তন করে দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট রাখা হয়।
জানা যায়, প্রায় তিন বছর ধরে নির্মিত দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইটটির ওজন দুই হাজার ২৩০ কেজি।
এর আগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরে সার্ক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঘোষণা দেন এবং সার্কের অন্য সাতটি দেশকে বিনা অর্থে এর সুবিধা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বারোপ
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সন্ধ্যায় গণভবন থেকে দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষে আয়োজিত যৌথ ভিডিও কনফারেন্সের বক্তৃতায় এ কথা বলেন।
এ সময় আরও বক্তৃতা করেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আশরাফ গনি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী থেসারিং তোবগে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম, নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল এবং শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা শ্রীসেনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, এই উপগ্রহ উৎক্ষেপণ দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোর দৃশ্যপট বদলে দেবে।”
এ সময় গণভবনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমসহ আমন্ত্রিত অতিথি এবং সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।