এক বছরে কড়াইল বস্তিতে তিনবার আগুন
2017.03.16
ঢাকা

আকস্মিক ও রহস্যজনক আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে রাজধানীর মহাখালীর কড়াইল বস্তির একটি এলাকা। এই নিয়ে গত এক বছরে কড়াইল বস্তিতে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটল। এতে কেউ হতাহত না হলেও সর্বস্ব হারিয়েছে কয়েক হাজার পরিবার।
ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর মাঝে প্রায় দেড় শ একরের বেশি জমিতে গড়ে ওঠা এই বস্তিতে কয়েক লাখ মানুষ বাস করেন, যাঁদের বেশির ভাগই স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী।
প্রাথমিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা যায়নি। তবে বস্তিবাসীদের কেউ কেউ বলছেন, গ্যাসের চুলা বা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে আগুন লাগতে পারে। কেউবা বলছেন, সিগারেটের আগুন থেকেও অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হতে পারে। বস্তির বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞ অনেকের মতে, এটা নাশকতাও হতে পারে।
বুধবার রাত পৌনে তিনটার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছেন বস্তিবাসী ক্ষতিগ্রস্তরা। পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় পর ভয়াবহ ওই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ বৃহস্পতিবার বেনারকে জানান, “আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। তবে এই ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে বস্তির রাস্তা খুব সংকীর্ণ হওয়ায় কাজ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বস্তির বউবাজার এলাকার একটি মসজিদের পাশ থেকেই আগুনের সূত্রপাত। এরপর মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিলে এবং মানুষের চিৎকারে বস্তিবাসী ঘুমন্ত অবস্থা থেকে কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
সরেজমিনে কড়াইল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বস্তির বউবাজার, জামাই বাজার এলাকার বেশির ভাগ বাড়ি পুড়ে গেছে। কাঠ এবং টিনের তৈরি বাড়িগুলো পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে যাওয়া সেসব ঘরের সামনেই অসহায়ের মতো বসে আছে ক্ষতিগ্রস্তরা।
বস্তির বউবাজারে পুড়ে যাওয়া একটি মুদি দোকানের সামনে বসে থাকতে দেখা গেল ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধাকে।
বেগম আক্তার নামের ওই বৃদ্ধা বেনারকে বলেন, “২০ বছর ধরে এখানে বসবাস করছি। এর মধ্যে দুইবার আগুনে সব হারিয়েছি। সকাল থেকে নাতিদের মুখে ভাত ওঠেনি। জানি না পরের বেলায়ও জুটবে কিনা।”
কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা যেন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর আগে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আগুন লাগে এই বস্তিতে। এই নিয়ে ২০১৬ সালের মার্চ থেকে এ বছরের ১৬ মার্চ পর্যন্ত তিনবার আগুনে পুড়ল কড়াইল।
তবে এটি নিছক দুর্ঘটনা নয় জানিয়ে নাশকতার অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই জমির মালিক মূলত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর। বিটিসিএলেরও এই জমিতে মালিকানা রয়েছে।
এর আগে এই বস্তি দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায় কৌশলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়ে বস্তিবাসীকে উচ্ছেদের চেষ্টা চলতে পারে।
জানা যায়, আদালতের আদেশ নিয়ে ২০১২ সালে এই জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে গণপূর্ত ও বিটিসিএল। সেবার প্রথম দিন অভিযান চালিয়ে চারশ’র মত ঘর উচ্ছেদ করা গেলেও পরদিন হাজার হাজার বস্তিবাসী গুলশান-মহাখালী এলাকার প্রধান সড়কে নেমে ওই এলাকা অচল করে দেয়। এরপরে আর এগোয়নি উচ্ছেদ অভিযান। আদালতও পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ নিষিদ্ধ করেছে।
এ বিষয়ে কড়াইল বস্তির বাসিন্দা সাত্তার মিয়া (৩৮) বেনারকে বলেন, “দুর্ঘটনা একবার ঘটতে পারে। কিন্তু তিন মাসে দুবার আগুন লাগা দুর্ঘটনা নয়, নাশকতাই বলা যায়।”
তিনি বলেন, “আমরা শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চাই। জমি উদ্ধার করতে চাইলে আমাদের অন্য জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।”
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে সরকারে দুই সংশ্লিষ্ট বিভাগ। বিটিসিএলের উপপরিচালক মোহাম্মদ মীর মোরশেদ বেনারকে বলেন, “বিটিসিএলের বিরুদ্ধে অগ্নিকাণ্ড ঘটানোর অভিযোগ সত্য নয়। কারণ, আমাদের জমি কারও দখলে নেই। আলাদা বাউন্ডারি করা আছে। তাই দখলের প্রশ্ন ওঠে না।”
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া বেনারকে বলেন, “আপাতত কড়াইলের বেদখল জমি উদ্ধারে আমাদের কোনো প্রচেষ্টা নেই। তাই বস্তিবাসীর এ অভিযোগ সত্য নয়। দুর্ঘটনা থেকে এ অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।”
পুনর্বাসনের দাবি
বিশ্লেষকেরা বলছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশ বা গণপূর্ত বিধিমালা অনুযায়ী এসব নিম্ন আয়ের লোকদের নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে নগর গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “ঢাকা শহরের বড় সংখ্যক দরিদ্র মানুষের আশ্রয় এই কড়াইল বস্তি। বহু বছর ধরে তারা বসবাস করছেন। তাঁদের এখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা সরকারের আছে। এই অগ্নিকাণ্ড সেই প্রচেষ্টা হতেও পারে, আবার দুর্ঘটনাও হতে পারে।”
তাঁর মতে, “এক বছরে তিনবার আগুন লাগা অস্বাভাবিক। তাঁদের তুলে দিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ আছে। তবে আগে তাঁদের পুনর্বাসন করতে হবে।”