বাংলাদেশের দুটি হ্যাকার গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল ফেসবুক
2020.12.11
ঢাকা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের অপব্যবহার, ম্যালওয়ার ভাইরাস ছড়ানো এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার দায়ে বাংলাদেশের দুটি এবং ভিয়েতনামের একটি হ্যাকার গ্রুপের সব অ্যাকাউন্ট ও পেজ বন্ধ করে দিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এক বিবৃতির মাধ্যমে এই ঘোষণা দেয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
বাংলাদেশ ভিত্তিক হ্যাকার গ্রুপ দুটির নাম ক্রাইম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস (ক্র্যাফ) এবং ডন’স অথবা ডিফেন্স অব দি নেশান্স। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই অলাভজনক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত। অন্যদিকে ভিয়েতনামের হ্যাকার গ্রুপের নাম এপিটি৩২।
বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশি হ্যাকারদের ব্যাপারে ফেসবুক জানায়, এই দুটি গ্রুপ পরস্পর যোগসাজসে স্থানীয় অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিক এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশানা করে তাঁদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করত।
ফেসবুক জানায়, বিভিন্ন ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে ফেসবুকের কাছে ভুয়া অভিযোগ পাঠাতে, ভুয়া মেধাস্বত্ব আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ করতে, নগ্নতা এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ আনতে ডিফেন্স অব নেশান্স ও ক্র্যাফ একে অপরের সহযোগিতা করেছে।
এই দুই হ্যাকার গ্রুপ বিভিন্ন ব্যবহারকারীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেজ হ্যাক করে সেগুলোকে তাদের অপকর্মের প্রয়োজনে লাগিয়েছে।
ফেসবুক জানিয়েছে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহৃত অ্যাকাউন্ট ও পেজগুলোকে তারা সরিয়ে ফেলেছে।
ভিয়েতনামের এপিটি৩২ হ্যাকার গ্রুপ সম্পর্কে ফেসবুক জানিয়েছে, এরা ভিয়েতনামের মানবাধিকার কর্মী, লাওস ও কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন বিদেশি সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ম্যালওয়ার পাঠাত।
ক্র্যাফের সাথে একসময় সংশ্লিষ্ট ছিলেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা।
তিনি বেনারকে বলেন, “এই হ্যাকারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সঠিক কাজ করেছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এরা হ্যাকিংয়ের সাথে যুক্ত। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই গ্রুপের সদস্যদের চিনি।”
তিনি বলেন, “আমি নিজেও ক্র্যাফের সাথে যুক্ত ছিলাম। যখন দেখলাম তারা হ্যাকিংয়ের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে তখন আমি নিজেকে গুটিয়ে নিই। আমি ২০১৭ সালে ক্র্যাফের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি।”
তিনি বলেন, “ক্র্যাফ ও ডন একই গ্রুপের হ্যাকাররা চালায়। তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে কাজ করে। তবে এই হ্যাকার গ্রুপের সদস্যরা খুব প্রভাবশালী।”
ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মাহবুবুল আলম বেনারকে বলেন, তারা এই দুই হ্যাকার গ্রুপকে চেনেন না। পুলিশ গ্রুপ দুটি সম্পর্কে কারো কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পায়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঘোষণা দিয়ে হ্যাকিং
২০১৭ সালে সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা চালাতে গিয়ে এই হ্যাকার গ্রুপের হ্যাকিংয়ের শিকার হন আইডিয়া অ্যান্ড স্টেপ নামক বেসরকারি সংগঠনের প্রধান নির্বাহী রাফায়েল আহসান নাওমি এবং আরেক উদ্যোক্তা মোহাইমেনুল ইসলাম চৌধুরী।
মোহাইমেনুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করি। সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে এরকম আরও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা আমাদের ছিল। এতে আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হয় ওই হ্যাকাররা। কারণ আমরা তাদের কাজের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম।”
“সাধারণত এই হ্যাকাররা হ্যাকিংয়ের আগে ফেসবুকে আগাম ঘোষণা দেয়। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার ঘোষণা দেয় তারা,” জানিয়ে মোহাইমেনুল বলেন, “একদিন দেখা গেলা আমাদের সিইও নাওমি ভাইয়ের ফেসবুক গায়েব। এটি হ্যাক করতে তারা তাঁর মোবাইল সিম ক্লোন করে।”
মোহাইমেনুল বলেন, “কিছু বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার কারণে তারা আমার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে পারেনি। কিন্তু তারা বিভিন্ন গ্রুপ থেকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে অন্যের অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের অসংখ্যক অভিযোগ আনে আমার বিরুদ্ধে।”
তিনি বলেন, “ফেসবুক আমাকে বিষয়টি অবহতি করলে আমি সেটির জবাব দিই এবং আমার অ্যাকাউন্ট রক্ষা করতে পারি।”
মোহাইমেনুল বলেন, “তাদের উদ্দেশ্য ছিল: আমার বিরুদ্ধে অন্যের অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কিত আমি যেসকল পাতার অ্যাডমিন সেগুলো বন্ধ হয়ে যেত।”
তবে ক্র্যাফের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে সংগঠনটির প্রধান জেনিফার আলম প্রথম আলো পত্রিকাকে বলেছেন, কেউ হয়তো ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে তাঁদের ব্যাপারে ভুল বুঝিয়েছে। আর এই কারণে তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা।
“ক্র্যাফ কোনো হ্যাকার গ্রুপ নয়,” দাবি করে জেনিফার বলেন, সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ ও সচেতনতা তৈরিতে চার বছর ধরে কাজ করছে তাঁর প্রতিষ্ঠান।
তাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করবেন বলেও জানান জেনিফার।
কয়েকটি নৃশংস সাম্প্রদায়িক ঘটনা
ফেসবুক হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে একাধিক নৃশংস সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজারের রামুতে এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যুবক উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে একটি ইসলাম বিরোধী পোস্ট দেয়া হয়। এই পোস্টকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আক্রমণ চালানো হয় বৌদ্ধ মন্দিরে। পুড়িয়ে দেয়া হয় শত বছরের বৌদ্ধ মন্দির, বৌদ্ধদের বাড়িঘর।
নিরক্ষর এক হিন্দু জেলে রসরাজ দাসের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুর করা হয়।
এছাড়া গত বছর অক্টোবরে ভোলায় এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক হ্যাক করে ইসলামের মহানবীকে নিয়ে ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য ছড়ানোর জেরে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা সামলাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হন।
সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যক্তির আইডি হ্যাক করে টাকা চাওয়া হচ্ছে। কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান ৯ ডিসেম্বর নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, “আমার আইডি হ্যাকড হয়েছে। আমার নামে টাকা চাওয়া হচ্ছে। কেউ টাকা দেবেন না।”
সোহরাব হাসানের এই স্ট্যাটাসের পর অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে সোহরাব হাসানের পক্ষে টাকা চাওয়া হয়েছে।
নুরুল আমিন নামে একজন শুক্রবার তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে হ্যাকারদের অপকর্ম সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বন্ধুদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।