অন্তর্দ্বন্দ্বে বিভক্ত তাবলিগ জামাত
2018.12.07
ঢাকা

কোন্দলের কারণে নির্দলীয় সংগঠন তাবলিগ জামাত এখন রীতিমতো দু’ভাগে বিভক্ত। নিজেদের মধ্যে মারামারি, দোষারোপ, বিক্ষোভ–মিছিল সমাবেশ এমনকি পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনও করছে তারা।
গত ১ ডিসেম্বর টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে দুই পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর থেকে তাবলিগ জামাত এখন বাংলাদেশে অন্যতম আলোচনার বিষয়। ময়দানের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ওই দিন দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন একজন মুসল্লি। আহত হন কয়েকশ।
দু’পক্ষের বিরোধিতার জেরে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্ব ইজতেমাও।
তাবলিগের বিভক্ত দুই পক্ষের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাবলিগের এই দ্বন্দ্বের শুরু হয় বর্তমান আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভী দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে।
২০১৫ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানের লাহোরের রাইবেন্ডে ইজতেমা চলার সময় সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৩ সদস্যের একটি ‘আলমি শুরা’ গঠনের প্রস্তাব আসে। কিন্তু সাদ সেই প্রস্তাব মানেননি।
তবে ইজতেমা শেষে রাইবেন্ড থেকে শুরা বোর্ড গঠনের একটি চিঠি বিভিন্ন দেশে তাবলিগের দায়িত্বশীলদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর এক পক্ষ সাদের সিদ্ধান্তের পক্ষে এবং আরেক পক্ষ আলমি শুরা গঠনের পক্ষে অবস্থান নেয়।
বাংলাদেশে তাবলিগের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন ১১ জন শুরা সদস্য। এর মধ্যে কাকরাইল মসজিদের খতিব মুহাম্মাদ জুবায়েরসহ পাঁচজন সাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আর সাদের পক্ষে অবস্থান নেন আরেক শুরা সদস্য সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলামের নেতৃত্বে বাকি ছয়জন।
সাদ বিরোধীদের মুরুব্বি ও ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক মসজিদের ইমাম মাওলানা আমানুল হক বেনারকে জানান, “মাওলানা এনামুল হাসান তার মৃত্যুর আগে তাবলিগ পরিচালনার জন্য দশজনের একটি জামাত গঠন করেছিলেন। এরা বিশ্বব্যাপী তাবলিগের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।”
“ভারতে তাবলিগের কার্যক্রম পরিচালনায় সাদসহ তিনজনের জামাতটি এই দশজনই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু একে একে সবার মৃত্যুর পর সাদকে যখন বলা হলো আবারও জামাত গঠন করতে সাদ তখন তা না করেই নিজেকে একক আমির হিসেবে ঘোষণা করলেন,” বলেন তিনি।
আমানুল হক বলেন, “বিভিন্ন সময়ে সাদের দেওয়া বক্তব্য নিয়ে আগেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। অন্তত ৮৫টি বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে তিনি তাবলিগের মধ্যেই সমালোচিত হয়ে আসছিলেন। সবশেষ আলমি শুরা গঠণের প্রস্তাব প্রত্যখ্যান করার পর বিভক্তি প্রকাশ্য রূপ নেয়।”
তবে এ বক্তব্য সত্য নয় বলে দাবি করেছেন সাদপন্থী মুরুব্বি আশরাফ আলী। তিনি বেনারকে বলেন, “১৯৯৩ সালে দশজনের ওই জামাত গঠন করা হয়েছিল তাবলিগের নেতৃত্ব নির্ধারণের জন্য। তারা তিনজনকে নির্ধারণ করে সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বাকি দুজন মারা যাওয়ার সাদ একাই আমিরের দায়িত্ব রয়ে যান।”
সাদের বিতর্কিত বক্তব্যের বিষয়ে আশরাফ আলী বলেন, “সাদ বিরোধীরা যে ৮৫টি বক্তব্যের কথা বলছেন তা তারা কখনোই সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন না। বিরোধ জিইয়ে রাখার জন্য তারা এটা বলে যাচ্ছেন।”
“দেওবন্দের আলেমরা সাদের সাতটি বক্তব্য নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। এসব বক্তব্যের জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছেন এবং দেওবন্দের আলেমরাও তা গ্রহণ করেছেন। এরপর এ নিয়ে আর কোনো বিরোধ থাকতে পারে না,” বলেন তিনি।
বিরোধের জের ধরে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমায় দিল্লি থেকে বাংলাদেশে এসেও টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে যেতে পারেননি সাদ। এরপর ২৬ এপ্রিল সাদ বিরোধীরা রাজধানীর বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে ছাত্রদের নিয়ে এসে কাকরাইলের মারকাজের নিয়ন্ত্রণ নেন।
পরদিন কয়েক হাজার সাদপন্থী কাকরাইলে উপস্থিত হলে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এরপর থেকে গত এক বছর ধরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই পক্ষের প্রকাশ্য বিরোধ চলে আসছিল।
এদিকে সেদিনের সংঘর্ষের জন্য সাদপন্থীদের দায়ী করে শুক্রবার দেশের বিভিন্ন স্থানে বাদ জুমা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন সাদ বিরোধীরা। তারা সাদপন্থী শুরা সদস্য ওয়াসিফুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন নাসিম, প্রকৌশলী ইউনুস শিকদার ও শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাসুদকে দায়ী করে তাঁদের গ্রেপ্তার দাবি করেছেন।
অনিশ্চিত ইজতেমা
সাদ বিরোধীদের ইজতেমা ময়দান থেকে সাদপন্থীরা তাড়িয়ে দিলে ১ ডিসেম্বর সংঘর্ষের সূচনা হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সাদপন্থীদেরকেও ময়দান থেকে বের করে দিয়ে এর নিয়ন্ত্রণ নেন।
বিরোধের কারণে সাদপন্থীরা আগামী ১১, ১২ ও ১৩ জানুয়ারি এবং সাদ বিরোধীরা ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব এবং ২৫, ২৬ ও ২৭ দ্বিতীয় পর্বের তারিখ নির্ধারণ করেছিল। দুই পক্ষ আলাদাভাবেই বিভিন্ন স্থানে তাদের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে মুখোমুখি হচ্ছিল।
এই দ্বন্দ্বের মধ্যে গত ১৫ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় আসছে বছরের বিশ্ব ইজতেমা স্থগিত ঘোষণা করে সরকার। দুই পক্ষকেই কোনো ধরনের জমায়েত না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৩০ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন থেকে পাঠানো এক চিঠিতেও একই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
সাদপন্থীরা বলছেন, সরকারের এসব সিদ্ধান্ত তাঁরা মেনে নিলেও সাদ বিরোধীরা বিভিন্ন স্থানে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ইজতেমা ময়দানেও তাঁরা তাঁদের নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী ইজতেমা পালনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে প্রশাসন যাতে হস্তক্ষেপ করে ময়দানের নিয়ন্ত্রণ নেয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যই তাঁরা ১ ডিসেম্বর টঙ্গীতে গিয়েছিলেন।
১ ডিসেম্বর সংঘর্ষের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুই পক্ষকে নিয়ে এক সভায় বসেন। সভায় শেষে তিনি জানান, ইজতেমার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি বা জোড় ইজতেমা দেশব্যাপী বন্ধ থাকবে। নির্বাচনের পর দুই পক্ষের সঙ্গে বসে ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
তাবলিগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাবলিগ কোনো নির্দিষ্ট মাজহাবকে সমর্থন করে না। সব মাজহাবের লোকজনই এখানে আসেন।
সাদ বিরোধীদের পক্ষে হেফাজতে ইসলাম
বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের বিরোধ সৃষ্টির পর সাদ বিরোধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কওমি মাদ্রাসার আলেমরা। আলেমদের সংগঠন হেফাজতে ইসলামও প্রকাশ্যে তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাসমূহের সবচেয়ে বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার (বেফাক) নেতারাও সাদ বিরোধীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাদ বিরোধীদের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসার আলেমদের সংগঠনগুলো যুক্ত হওয়ায় এখানে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক বিভিন্ন উদ্দেশ্যও যুক্ত হয়ে গেছে। তাই এই বিরোধের নিষ্পত্তি শিগগির হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
হেফাজতের এই সংযুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ভিক্টোরিয়া পার্ক মসজিদের ইমাম মাওলানা আমানুল হক বলেন, “হেফাজতের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে শুধুমাত্র শরিয়তের জায়গা থেকে। এখানে কোনো রাজনীতি নেই। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ডেও তারা কখনো যুক্ত হবেন না।”
অন্যদিকে সাদপন্থী মুরুব্বি মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “তাবলিগে কখনোই রাজনীতি ছিল না। তাবলিগের অভ্যন্তরীণ সমস্যা এখন পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও কওমির আলেমেরা নানভাবে তাঁদের অনুসারিদের হেনস্থা করছেন। আর এসই হচ্ছে সাদ বিরোধীরা এখানে রাজনীতির সংযুক্তি ঘটানোয়।”