দুই দলের প্রকাশ্য বিরোধের মধ্য ঢাকায় শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা
2024.01.31
ঢাকা

দিল্লিভিত্তিক তাবলিগ জামাতের একাংশের আমির মাওলানা সাদ কান্দালভীকে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে অংশ নিতে দেওয়ার দাবি জানালেও মাওলানা জুবায়ের আহমদ পক্ষের অনুসারীরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সাধারণ মুসল্লি পরিষদের ব্যানারে মাওলানা সাদের অনুসারীরা বুধবার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে গণসমাবেশ ও মানববন্ধন করেন।
শুক্রবার টঙ্গীর তুরাগ তীরে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। এবারও দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি বছর ১০ লাখেরও বেশি মানুষ ইজতেমায় অংশ নেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম পর্বে মাওলানা জুবায়ের আহমদ পক্ষের অনুসারীরা ও দ্বিতীয় পর্বে ৯-১১ ফেব্রুয়ারি মাওলানা সাদ কান্দালভীর নেতৃত্বাধীন মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলাম পক্ষের অনুসারীরা অংশ নেবেন।
প্রসঙ্গত, দেওবন্দের আলেমদের সঙ্গে দিল্লির নিজামুদ্দিনের মুরব্বি মাওলানা সাদ কান্দালভীর মত পার্থক্যের জের ধরে ২০১৮ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দ্বন্দ্ব এড়াতে গত কয়েক বছর সাদকে ইজতেমায় আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
বিভক্ত তাবলিগ জামাতকে একত্রিত করতে এদিন গণসমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন মুসল্লিরা।
মাওলানা জুবায়েরপন্থীদের মুখপাত্র বেনারকে জানিয়েছেন মাওলানা সাদের উপস্থিতি তাঁরা মেনে নেবেন না।

এক পর্বে ইজতেমার দাবি
সাদপন্থী গ্রুপের সাথী মিজানুর রহমান বুধবার বেনারকে বলেন, “আমাদের দাবি, আগামী শুক্রবার শুরু হতে যাওয়া ইজতেমায় মাওলানা সাদকে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। আমরা চাই, আগের মতো ইজতেমা এক পর্বে অনুষ্ঠিত হোক। কোনো বিভাজন থাকবে না।”
“আমাদের আশঙ্কা, যদি আমির মাওলানা সাদকে এখানে আসতে দেওয়া না হয়, তাহলে এই ইজতেমা তৃতীয় কোনো দেশে চলে যাবে। এই সমস্যা সমাধানে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করি,” যোগ করেন তিনি।
এই প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বুধবার বেনারকে বলেন, “আমরাও চাই তারা দুই গ্রুপ তাদের মত পার্থক্য ভুলে একসঙ্গে কাজ করুক। আমি নিজে তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছি। কিন্তু তারা তো নিজেদের সমস্যা মেটাতে পারছেন না।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এই সমস্যা সমাধানের জন্য দুই পক্ষকে আলাদা আলাদা সময় দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ইজতেমা আয়োজন করতে পারে।
“আশা করি কোনো সহিংসতা হবে না। যদি তারা সংঘাতে লিপ্ত হয়, তাহলে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে,” বলেন তিনি।
দুই পক্ষের সঙ্গেই সরকার আলোচনা করেছে জানিয়ে ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল ইসলাম বুধবার বেনারকে বলেন, এখন আর নতুন করে কিছু ভাবার সময় নেই।
“যার যার মতো দুই পক্ষকে ইজতেমা আয়োজন করতে বলেছি। এরপরও যদি তারা সুষ্ঠুভাবে ইজতেমা পালন করতে না পারেন তাহলে সরকারের পক্ষে কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না,” বলেন ধর্মমন্ত্রী।
মুসল্লিদের সুবিধার জন্য ইজতেমা এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেতু তৈরি করছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া নিরাপত্তার জন্য পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে আসন্ন ইজতেমার প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে বুধবার টঙ্গীর তুরাগ তীর পরিদর্শন করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ইজতেমা প্রাঙ্গণে ১৫ হাজার পুলিশ সদস্য ছাড়াও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল, সোয়াত সদস্য, ডগ স্কোয়াড, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দল, নৌ-টহল দল ও হেলিকপ্টারে টহল থাকবে।
দুই পক্ষের যুক্তি
মাওলানা জুবায়েরপন্থীদের মিডিয়া সমন্বয়ক জহির ইবনে মুসলিম বুধবার বেনারকে বলেন, “আমাদের কথা হলো, উনি (সাদ) যতক্ষণ তাঁর ভুল স্বীকার না করবেন, অথবা ইসলাম সম্পর্কে তাঁর ভুল ব্যাখ্যা থেকে সরে না আসবেন, ততক্ষণ আমরা তাঁকে ইজতেমায় আসতে দেবো না।”
জহির বলেন, “মাওলানা সাদের সঙ্গে মাওলানা জুবায়েরের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব নেই। মাওলানা সাদ বিভিন্ন সময় ইসলামের ঈমান-আক্বিদার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন, ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেগুলো মুসলমানদের আহত করেছে। সে কারণেই তাবলিগ জামাতের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।”
ভারতের মাওলানা সাদ কান্দালভীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে তাবলীগ জামাতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। কান্দালভী তাবলীগ জামাতে কিছু সংস্কারের কথা বলে আসছিলেন। তাঁর একটি বক্তব্য ছিল যে “ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়।”
অনেকেই মনে করেন যে এই বক্তব্যের মাধ্যমে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিনিময়ে অর্থ নেয়ার বিপক্ষে বলা হয়েছে।
সাদ কান্দালভী সে সময়ে আরও বলেছিলেন, “মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত, যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।”
এসব বক্তব্য ভারতে তাবলীগ জামাতের একাংশকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। বিশেষ করে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ তাঁর বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে।
দারুল উলুম দেওবন্দ-এর সাদ বিরোধী অবস্থান প্রকাশ্য হওয়ার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। বিভক্ত হয়ে পড়েন বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের শীর্ষ নেতারা।
তবে মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ অসত্য দাবি করে মিজানুর রহমান বলেন, “মাওলানা সাদ কোনোভাবেই ইসলামের ঈমান-আক্বিদার বিরুদ্ধে কথা বলেননি।”
তিনি বলেন, “উনারা সুরা-ই নিজামের পক্ষে, আমরা নই। সুরা-ই নিজামের মূল কথা হলো, এখানে একক কোনো আমির থাকবে না। তাবলিগ জামাত, ইজতেমা সব কিছুই চলবে একটি রার (পরিষদের) মাধ্যমে; যদিও এটি ইসলামের বিধান নয়।”
“ইসলামে সব সময় একই খলিফা ছিলেন, যাঁর নেতৃত্বে সব কিছু পরিচালিত হতো। মাওলানা সাদ আমির; উনাকে তাঁরা মানবেন না।”

বিশ্ব ইজতেমার পটভূমি
ভারত বিভাগের আগের বছর ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্কের পাশে কাকরাইল মসজিদ থেকে ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। তাবলিগ জামাত এই আয়োজন করে থাকে।
ভারত ভাগের পর ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) চট্টগ্রামে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়।
ধীরে ধীরে ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৯৬৭ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেওয়ায় এই গণজমায়েতকে বিশ্ব ইজতেমা বলে অভিহিত করা হয়।
হজের পরে বিশ্ব ইজতেমা বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো মুসলিম জমায়েত।
শুরুতে তাবলিগ জামাতের প্রধান ছিলেন দিল্লির আলেম মাওলানা ইলিয়াস রহমান। তাঁর মৃত্যুর পর দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাওলানা ইউসুফ। তাঁর পরে মাওলানা এনামুল হাসান।
এর পরে কোনো একক ইমাম ছিলেন না। একটি শূরার মাধ্যমে ইজতেমা পরিচালিত হতো।
মাওলানা জুবায়েরপন্থীদের অভিযোগ, ২০১৭ সালে মাওলানা সাদ শূরার অনুমোদন ছাড়াই এককভাবে নিজেকে ইমাম ঘোষণা করেন। তাঁর নেতৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানান মাওলানা জুবায়ের ও তাঁর অনুসারীরা।
এই প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মধ্যস্থতায় দুই পর্বে ইজতেমা ভাগ করে দেওয়া হয়।
গত রোববার ঢাকার উত্তরায় একটি মসজিদে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০জন আহত হন। গত বছর ঢাকায় তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত হন।