বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ: হেফাজতের হুমকিতে পিছু হটবে না সরকার
2020.11.30
ঢাকা

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবিত ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে গত দুই সপ্তাহ ধরে পরষ্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে সরকার ও কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত ১৫ নভেম্বর নতুন কমিটি গঠন হওয়ার পর অরাজনৈতিক এই ধর্মীয় সংগঠনটি স্পষ্টত সরকারের হাতছাড়া হয়ে গেছে, এতে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে সরকারবিরোধী শিবির।
হেফাজতের আমির আহমেদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনটির আমিরের দায়িত্ব নিয়ে জুনায়েদ বাবুনগরী প্রকাশ্য জনসমাবেশে জানিয়েছেন, ভাস্কর্য নির্মাণের নামে মূর্তি নির্মাণ করা হলে তা ভেঙে ফেলা হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের সব কর্মসূচিতে গুরুত্ব পাচ্ছে ভাস্কর্য অপসারণের প্রসঙ্গ।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক সোমবার বেনারকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হবেই।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, উগ্রবাদী সংগঠনগুলো ইসলামের অপব্যাখ্যা করে ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছে। প্রয়োজন হলে সরকার এদের কঠোরভাবে দমন করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে, জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের প্রধান হওয়ার পর সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাথে সংগঠনটির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। কারণ, বাবুনগরী বিএনপি-জামায়াত সমর্থক বলে পরিচিত। এই ইস্যুতে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তাঁরা।
হেফাজতে ইসলামীর সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী সোমবার বেনারকে বলেন, “ভাস্কর্য এবং মূর্তি একই। এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইসলামে মূর্তির কোনো স্থান নেই। ইসলাম এসেছে মূর্তি ধ্বংস করতে, মূর্তি স্থাপন করতে নয়। মক্কা বিজয়ের পর সেখানকার সকল মূর্তি ধ্বংস করা হয়।”
তিনি বলেন, “আমরা মুসলমান। ধর্ম আগে, দেশ পরে। বঙ্গবন্ধুকে আমরা সম্মান করি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা। কিন্তু মূর্তি তৈরি করে তাঁকে অসম্মান করার অধিকার কারো নেই। সেই কারণে আমরা এর বিরোধিতা করছি।”
আজিজুল ইসলাম বলেন, “মূর্তি বঙ্গবন্ধুর হোক, আর জিয়াউর রহমানের হোক আমরা মানব না। আমরা চাই সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে।”
গত ১৮ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ ফুট উচ্চতার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হবে।
“হেফাজতের বক্তব্য নিয়ে আমাদের মাথা ব্যাথা নেই,” মন্তব্য করে মন্ত্রী মোজাম্মেল সোমবার বেনারকে বলেন, “সরকার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করবেই। ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কোনো কারণ নেই।”
সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস জানায়, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত ২২তম নবীন শিল্পী চারুকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, “মুজিববর্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য এ দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপর চ্যালেঞ্জ। অন্য কোনো পথ বা ইস্যু না পেয়ে ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে এনে ধর্মীয় সহনশীলতা বিনষ্টের যে কোনো অপচেষ্টা সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে।”
তিনি বলেন, ভাস্কর্যকে মূর্তি বলে আখ্যা দিয়ে ইসলামের অপব্যাখ্যা করছে উগ্রবাদী সংগঠনগুলো।
ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা হতে পারে না জানিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, “এ বিষয়ে কোনো আপস নেই। সরকারের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংবিধান ও রাষ্ট্রবিরোধী কোনো বক্তব্য বরদাশত করা হবে না।”

‘আওয়ামী লীগ বসে থাকবে না’
মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকার ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান।
তিনি বেনারকে বলেন, “এই ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্তকে নিয়ে অযথাই বিতর্ক সৃষ্টি করছেন হেফাজতসহ বাংলাদেশে যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন তাঁরা। এর উদ্দেশ্য, একটি রাজনৈতিক ইস্যু তৈরির অপপ্রয়াস। এর মাধ্যমে তাঁরা বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চান।”
“বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়া হবে আর আওয়ামী লীগ বসে থাকবে—এটি হবে না, হতে পারে না। আমরা বলেছি, আমরা সভ্যভাবে এই বিষয়টি সমাধান করতে চাই। আমাদের সভ্য আচরণ দুর্বলতা নয়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হবেই,” বলেন সাবেক এই মন্ত্রী।
বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি আইনত দণ্ডনীয় জানিয়ে শাজাহান খান বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ভাস্কর্য ছড়িয়ে আছে। সেগুলো নিয়ে কোনো কথা নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্ক করা হচ্ছে। এর কারণ স্বাধীনতা বিরোধিরা বাংলাদেশের ভিত্তিমূলে আঘাত করতে চায়। তারা বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিতে চায়।”
তিনি বলেন, “জুনায়েদ বাবুনগরীসহ হেফাজত নেতারা বিএনপিপন্থী। তাঁরা বিএনপি-জামায়াতের সাথে হাত মিলিয়েছে। তবে তাদের এই অপপ্রয়াস সফল হবে না।”
তিনি বলেন, তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বিভিন্ন ভাস্কর্য রয়েছে। সেখানে তো সেগুলোকে ইসলাম বিরোধী বলা হয় না।
এদিকে হেফাজতে ইসলামীর আজকের অবস্থান তৈরির পেছনে “আওয়ামী লীগের সমর্থন ছিল” বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বেনারকে বলেন, “বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে আওয়ামী লীগ হেফাজতকে ব্যবহার করেছে। আহমদ শফী ছিলেন সরকারপন্থী। তাঁর মৃত্যুর পর হেফাজতের নেতৃত্ব এখন বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিত জুনায়েদ বাবুনগরীর হাতে।”
তিনি বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মূর্তি পছন্দ করেন না। হেফাজত সাধারণ মানুষের এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করছে। তবে এর পেছনে রাজনৈতিক উস্কানি আছে, সেটি সত্য।”
হেফাজতের দাবির প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে সরে আসলে একদিকে কিছু মানুষ আওয়ামী লীগকে সম্মান করবে, অন্যদিকে বিরোধিরা এটিকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরাজয় বলে প্রচার করবে জানিয়ে তিনি বলেন, “দেখার বিষয় সরকার কীভাবে এই পরিস্থতি মোকাবেলা করে।”