পিটিয়ে ভাস্কর্য-বিরোধীদের ছত্রভঙ্গ করেছে পুলিশ
2020.12.04
ঢাকা

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নতুন আমির জুনায়েদ আহমেদ বাবুনগরীর অনুসারী আলেমরা ভাস্কর্য ও মূর্তি বিষয়ক ফতোয়া দেওয়ার পরদিনই ঢাকায় ভাস্কর্য-বিরোধী আন্দোলনকারীদের লাঠিপেটা করেছে পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শুক্রবার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ থেকে জুমার নামাজ শেষে বের হয়ে একদল মুসল্লি রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় পুলিশ তাঁদের পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
পুলিশ জানায়, জুমার নামাজের পর মসজিদের সিঁড়িতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন কয়েকশ মুসুল্লি। ভাস্কর্যবিরোধী নানা স্লোগান দিয়ে মসজিদের উত্তর পাশের ব্যারিকেড ভেঙে পল্টন মোড়ে আসার পর পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় কিছু মুসল্লি পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন।
পুলিশের মতিঝিল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু সাংবাদিকদের জানান, বুধবার থেকে অনুমতি ছাড়া যেকোনো কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।
“তবুও জুমার নামাজের পর কিছু মানুষ বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে বের হয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল শুরু করেন। তাঁরা শাহবাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে,” বলেন তিনি।
তবে কোনো ধরনের সাংগঠনিক ব্যানার ছাড়া এই বিক্ষোভটি কারা আয়োজন করেছিল, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি বলে জানান পুলিশের এডিসি।
বিক্ষোভকারীদের ‘সাধারণ মুসুল্লি’ দাবি করে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আল্লামা আব্দুর রব ইউসুফী বেনারকে বলেন, “পুলিশ অমানবিকভাবে মুসল্লিদের পিটিয়েছে, এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”
“যে কোনো ইস্যুতে দেশের জনগণ স্বাধীনভাবে প্রতিবাদ জানাবে, মিছিল-সমাবেশ করবে; এতে বাধা দেওয়ার অধিকার পুলিশের নেই। এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই,” বলেন তিনি।
এর আগে গত শুক্রবারও জুমার নামাজের পর বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে ব্যানার ছাড়া বিক্ষোভ মিছিল বের করে পুলিশের লাঠিপেটা ও গ্রেপ্তারের শিকার হন ভাস্কর্য-বিরোধী কিছু মানুষ।
তবে গতকালের মিছিল থেকে কাউকে আটক করা হয়নি উল্লেখ করে পুলিশের এডিসি জানান, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ আগে থেকেই সতর্ক ছিল।
ফতোয়া বিতর্ক
ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয় বলে সরকারি দল ও বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের যে দাবি তা নাকচ করে ফতোয়া দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের অনুসারী একদল আলেম।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) বৃহস্পতিবার বিকেলে ‘দেশের শীর্ষ উলামা-মাশায়েখ’ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে এই ফতোয়া দেন তাঁরা। সমবেতদের পক্ষে তা পাঠ করেন রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার ইসলমিক রিচার্স সেন্টারের সিনিয়র মুহাদ্দিস মুফতি এনামুল হক।
প্রাণীর ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে পার্থক্য করে ভাস্কর্যকে বৈধতা দেওয়া কোরআনের অবমাননা বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়।
ওই দিন নবনিযুক্ত ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান দুলাল সাংবাদিকদের বলেন, “ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়, এ সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি আছে।”
এদিকে হেফাজতে ইসলাম এর নতুন নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী গত মাসে “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য বিরোধী কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করার পর থেকেই এই বিতর্কের সূত্রপাত। তারই ধারাবাহিকতায় এই ফতোয়া এসেছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আরাফাত হোসেন খান।
তিনি বলেন, “আলেমদের মনে রাখা উচিত, ২০১১ সালে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া ফতোয়া বিষয়ক রায়ে বলা হয়েছিল, দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা কোনো ব্যক্তির স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ন বা প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ দিতে পারবেন না।”
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা করা বা তা ভেঙে ফেলার দাবি সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল বলেও মনে করেন তিনি।
তবে আব্দুর রব ইউসূফীর দাবি, বঙ্গবন্ধুর সম্মান রক্ষার্থেই ভাস্কর্য-বিরোধিতা করছে হেফাজতের নতুন নেতৃত্ব।
এদিকে হেফাজতে কোনঠাসা হয়ে পড়া সরকারপন্থী বলে খ্যাত প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর অনুসারীরা মনে করছেন, বাবুনগরীর সমর্থকেরা কৌশলগত কারণে ব্যানার ছাড়া ভাস্কর্য বিরোধী আন্দোলন এগিয়ে নিতে চান।
হেফাজতের এই অংশের অন্যতম নেতা মাওলানা মঈনুদ্দীন রুহীর এবং মাওলানা আলতাফ হোসেন বেনারকে জানান, ভাস্কর্য বিরোধিতার নামে বিএনপি-জামায়াত জোট সমর্থিত বাবুনগরী ও তাঁর সহযোগীরা “সরকারকে চাপে রাখতে চাচ্ছে।”
সংখ্যালঘুদের প্রতিবাদ
ভাস্কর্য বির্তকে মূর্তি প্রসঙ্গটি অবজ্ঞা ও অবহেলায় আলোচিত হচ্ছে দাবি করে শুক্রবার এক বিবৃতিতে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশের সংখ্যালঘুদের সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
পরিষদ মনে করে, এর মধ্য দিয়ে দেশে অপরাপর ভিন্ন সম্প্রদায় এবং তাঁদের ধর্মীয় অনুভূতিকে অহেতুক হেয় এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।
পরিষদ বলেছে, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় শাশ্বতকাল থেকে মূর্তি পূজা করে আসছে। বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায় ঠিক একইভাবে ভগবান বুদ্ধ ও প্রভু যীশুর মূর্তিকে সামনে রেখে তাঁদের ধর্মচর্চা করেন।
এদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে বা তাদের ধর্মকে অবজ্ঞা করে যেভাবে ‘মূর্তি’ শব্দটিকে বিদ্যমান বির্তকে তুলে ধরা হচ্ছে তা দুঃখ ও উদ্বেগজনক।