মন্ত্রিসভায় দুই মন্ত্রীর থাকা নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক
2016.03.28
উচ্চ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত—সরকার বা সরকারি দলে এমন মত থাকলেও বিষয়টি নিয়ে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।তবে আদালত অবমাননায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় নৈতিকতার প্রশ্নে তাঁদের সরে যাওয়া উচিত বলে মত দিচ্ছেন অনেকেই।
গত রোববার আদালত দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আ ক ম মোজাম্মেলকে সাজা দেওয়ার পর তাঁদের মন্ত্রিত্ব থাকবে কিনা—তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে তাঁরা অংশ নেন।
দুই মন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন কিনা, তা নিয়ে গণমাধ্যমের আগ্রহ ছিল। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকেরা ওই দুই মন্ত্রীর কাছে সাজা পাওয়ার পর তাঁদের করণীয় সম্পর্কে বক্তব্য জানতে চান। তাঁরা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে কামরুল ইসলামের একটাই জবাব ছিল— ‘কিছু বলার নেই।’
অন্যদিকে আ ক ম মোজাম্মেল বারবার ‘নো কমেন্টস’ বললেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে কিছু মন্তব্য করেন। পদত্যাগ করবেন কিনা—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মোজাম্মেল বলেন, রায়ের কপি পেয়ে মন্তব্য করবেন।উচ্চ আদালতের এই আদেশ রিভিউ করবেন কিনা—জবাবে তিনি বলেন, রায় পেলে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেবেন।
বিব্রত কিনা—এর জবাবে মন্তব্য না করে মোজাম্মেল বলেন, ‘বিষয়টি আপনারা (সাংবাদিকেরা) বিবেচনা করেন। জাতি বিবেচনা করুক।’ সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, অসাংবিধানিক কোনো কাজ করেননি। কারও বিপক্ষে কথা বলা মানে সংবিধান লঙ্ঘন নয়। সংবিধানের প্রতি তাঁর আনুগত্য আছে।
মন্ত্রিসভায় থাকা নিয়ে বিতর্ক
আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে মন্ত্রিত্ব যাওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করে। আর ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংসদ সদস্য তাঁর সদস্যপদ হারাবেন যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। দুই মন্ত্রীর বিষয়ে ৬৬ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য নয়। কারণ, তাঁরা নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দণ্ডিত হননি।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, “আদালত নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যে মন্ত্রীদের শপথ ভঙ্গ হয়নি।”
“এখানে একটি আইনগত, আরেকটা নৈতিক বিষয় আছে।নৈতিকতার ব্যাপারটা যার যার নিজের। সেটা নিয়ে কিছু বলার নাই। এটা সম্পূর্ণ তাদের ব্যক্তিগত বিবেচনার ব্যাপার,” জানান আইনমন্ত্রী।
তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, নৈতিক কারণে তাঁদের মন্ত্রী পদে থাকা উচিত নয়।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ অবশ্য বেনারকে বলেন, “আদালত অবমাননায় সাজাপ্রাপ্ত দুই মন্ত্রীর পদে থাকতে কোনো বাধা নেই।”
“কোনো আইনে এ-সংক্রান্ত বিধান নেই। তবে এটা নীতি ও মূল্যবোধের ব্যাপার। দুই মন্ত্রী দণ্ডিত অপরাধী। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দৃষ্টিতে এমন ব্যক্তিরা মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন না,” বেনারকে জানান আইনজীবী শাহদীন মালিক।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির বিদায়ী সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও সম্পাদক এম মাহবুব উদ্দিন খোকন অবিলম্বে দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন।
আদালতের রায়ের পর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মন্ত্রী হিসেবে থাকার নৈতিক অধিকার নেই বলে মনে করে বিএনপি। নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার রায়ের বিষয়ে উচ্চ আদালতের দেওয়া এই রায় ঐতিহাসিক। বিএনপি মনে করে, এই রায়ের পরে দুই মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ে থাকা বা সরকারে থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই।
দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদেশ
গত রোববার দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আ ক ম মোজাম্মেল হককে গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেন সর্বোচ্চ আদালত। তাঁদের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেন আপিল বিভাগ।
এর আগে ৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় খাদ্যমন্ত্রী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির আদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর আপিল মামলা পুনঃশুনানির দাবি জানিয়েছিলেন। ওই শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে অংশ না নেওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
একই অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। এরপর ৮ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল দেন আপিল বিভাগ।
রোববার আদেশে আপিল বিভাগ বলেন, “দুই মন্ত্রী নিঃশর্ত ক্ষমা ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে যে আবেদন করেছেন তা গ্রহণ করতে আমরা অপারগ। আবেদনকারীরা মন্ত্রী, সাংবিধানিক পদধারী। তাঁরা সংবিধান রক্ষার শপথবদ্ধ। প্রধান বিচারপতি ও সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননা করে তাঁরা যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমাদের কাছে উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হয়েছে।”
আদেশে আরও বলা হয়, “তাঁদের বক্তব্য বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল এবং বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। যদি তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে যেকোনো ব্যক্তি বিচার বিভাগ সম্পর্কে একই রকম অবমাননাকর বক্তব্য দেবেন। এ জন্য তাঁদের গুরুতর আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হলো।”
এখনই বাদ পড়ছেন না
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক সূত্র বলেছে, এই মুহূর্তে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়ছেন না সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডিত দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও আ ক ম মোজাম্মেল হক। তবে এখন সরানো না হলেও তাঁরা ঝুঁকিমুক্ত নন।
আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের আগে বা পরে মন্ত্রিসভায় রদবদলের যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে অন্যদের মধ্যে এই দুই মন্ত্রীর নামও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, এখনই তাঁদের সরানোর জন্য কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে যে নৈতিক প্রশ্ন উঠেছে, এতে কারও সন্দেহ নেই।
তবে খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি দলের নেতা ও আইনজীবীদের একটি বড় অংশ মনে করেন, আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নৈতিকতার প্রশ্নে দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।
গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, “আমাদের সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি, এটা হলো সত্য কথা। কারণ দেশের প্রধান বিচারপতি প্রতিষ্ঠান। তার ব্যাপারে ঢালাও মন্তব্য করা সংগত নয়, সমীচীন নয়।”
দুই মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত কী না—এমন প্রশ্নে সেতুমন্ত্রী বলেন, “আমার কলিগের পদত্যাগ আমি দাবি করব—এটা তো ঠিক না।”
অভিযুক্ত হওয়ার পর দুই মন্ত্রী পদে থাকতে পারেন কী না এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল হক বলেন, “এখানে এটা একদমই পরিষ্কার, এখানে কিন্তু সংবিধান ক্ষুণ্ন হওয়ার কোনো ব্যাপার নাই। এখানে পদত্যাগ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। এটা সম্পূর্ণ তাদের ব্যক্তিগত বিবেচনার ব্যাপার।”