খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলার বিচার ফের শুরু

পরিতোষ পাল
2017.07.13
কলকাতা
খাগড়াগড়ের ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে পুলিশ ও দমকল কর্মী। খাগড়াগড়ের ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে পুলিশ ও দমকল কর্মী। অক্টোবর ০৩, ২০১৪।
বেনার নিউজ

জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলার বিচার ফের শুরু হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পরে এই মামলার কার্যক্রম গত বছর বন্ধ হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার কলকাতার নগর দায়রা আদালতে রুদ্ধদ্বার এজলাসে বিচার কার্যক্রম চলেছে।

ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ-র আইনজীবী শ্যামল কুমার ঘোষ বেনারকে বলেন, “প্রথম সাক্ষ্য পুলিশ অফিসার আব্দুল গফ্ফর দিলেন। সেই সময় বর্ধমান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তিনিই ঘটনার এফআইআর করেছিলেন। এদিনই তাঁর সাক্ষ্য শেষ হয়েছে।”

তিনি বলেন, “গত বছরের আগস্টে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলেও নতুন করে এই বিস্ফোরণের ঘটনায় যুক্ত দুই বাংলাদেশি নাগরিকসহ তিনজন ধরা পড়ায় এদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করার জন্য বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছিল।”

এনআইয়ের সূত্রে বলা হয়েছে, এই মামলায় পাঁচ পর্বে মোট ৩৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ২৫ জন বর্তমানে ভারতের জেলে এবং একজন বাংলাদেশের পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।

কওসার, কদর কাজি, তালহা শেখ, বোরহান শেখ, সাদিক, জহিরুল শেখসহ জেএমবির সক্রিয় ৭ সদস্য এখনো পলাতক। ২৫ জনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়েছে।

শ্যামল ঘোষ বলেন, “অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ), সন্ত্রাস আইন, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক আইন ও বিদেশি আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে। সার্কভুক্ত কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা যুদ্ধের চেষ্টার জন্য ভারতীয় পেনাল কোডের ১২৫ ধারা অনুয়ায়ীও অভিযোগ আনা হয়েছে।”

এনআইয়ের এক শীর্ষ কর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে ধৃত সোহেল ওরফে নাসিরুল্লার সঙ্গে কথা বলে বাকি পলাতকদের খোঁজ পাওয়ার চেষ্টা করা হবে। শিগগিরই ভারতীয় গোয়েন্দারা ঢাকা যাবেন কথা বলতে।”

“ভারতে জেএমবির ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে আটজন বাংলাদেশিও রয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচজন ভারতের জেলে রয়েছে। একজন বাংলাদেশের হেফাজতে। বাকিরা এখনো পলাতক,” বলেন তিনি।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণ

২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ের একটি দোতলা বাড়িতে গোপনে বোমা তৈরির সময়ে আচমকা বিস্ফোরণে দুই জঙ্গি শাকিল গাজি ও করিম শেখ নিহত হয়।

পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুই শিশুসহ গুলসোনা বিবি এবং আলিমা বিবি নামে দুই মহিলাকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তে বেরিয়ে আসে, বিস্ফোরণে নিহত দুজনই ছিল বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবির সদস্য।

বিস্ফোরণের পর প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। তবে ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে (১০ অক্টোবর, ২০১৪) এনআইএ তদন্তের দায়িত্ব নেয়।

খাগড়াগড়ের এই বাড়ির দোতলাতেই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ১০ অক্টোবর ২০১৪।
খাগড়াগড়ের এই বাড়ির দোতলাতেই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। ১০ অক্টোবর ২০১৪।
বেনার নিউজ

ভারতে জেএমবির কর্মকাণ্ড

বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জামাআতুল মুজাহিদীন (জেএমবি) ভারতের তিন রাজ্যে কীভাবে নেটওয়ার্ক তৈরি করে জিহাদি কার্যক্রম চালাচ্ছিল, তা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে প্রথম প্রকাশ পায় বলে পুলিশ জানিয়েছে।

তদন্ত শেষে আদালতে পেশ করা এনআইএয়ের অভিযোগপত্রে বলা হয়, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্রে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যায়। জেএমবি প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ঝাড়খন্ডে ঘাঁটি তৈরি করে এবং পরে তা অন্য আরও কয়েকটি রাজ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল।

আদালতে পেশ করা নথিতে বলা হয়েছে, তদন্তে উঠে এসেছে যে, পরিকল্পনা মাফিক ও অত্যন্ত সংগঠিতভাবে কিছু যুবককে সংগঠনে নিয়োগ করে তাদের জিহাদি কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করতে মগজধোলাই ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল জেএমবি। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম, ঝাড়খন্ডের সাহেবগঞ্জ এবং আসামে জেএমবির সাংগঠনিক ঘাঁটিও তৈরি করা হয়েছিল।

এনআইএয়ের আইনজীবী শ্যামল কুমার ঘোষ বেনারকে বলেন, “জঙ্গিদের বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করা এবং সেখানে শরিয়তি শাসন চালু করা।”

এনআইয়ের এক কর্তা বেনারকে বলেন, “বিস্ফোরণের ঘটনার অনেক আগে থেকেই জেএমবির নেতারা পশ্চিমবঙ্গে মডিউল তৈরির কাজ শুরু করেছিল। এ জন্য বিভিন্ন মাদ্রাসাকে গোপন কার্যক্রমের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল।”

“এই সব মাদ্রাসা ও গোপন ঘাঁটিতে জেহাদীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ যেমন দেওয়া হতো তেমনি গ্রেনেড ও আইইডি তৈরির কাজ হতো। ধৃতদের জেরা করে এই তথ্য জানা গেছে”, বলেন তিনি।

আইনজীবী ঘোষ বলেন, “তদন্ত চলাকালীন ৬৬০ সাক্ষীর বয়ান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আদালতে সেই বয়ান পেশ করার পাশাপাশি প্রায় ৩৫০০ পাতার নথি ও অন্যান্য দলিল প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে।”

প্রমাণাভাবে মামলা থেকে বাদ

খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও মোট ৩৪ জনকে অভিযুক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে। সালাউদ্দিন সালেহিন নামে এক বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ৫ লাখ রুপি ইনাম ঘোষণা করে পরোয়ানা জারি হলেও তার বিরুদ্ধে এনআইএ প্রমাণাভাবে অভিযোগপত্র দিতে পারেনি বলে তদন্তকারী এক কর্মকর্তা বলেন।

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্ত নিয়ে নিয়মিত খবর করার কাজে যুক্ত কলকাতার এক সাংবাদিক বেনারকে বলেন, “জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা সালাদ্দিনের নিয়মিত যাতায়াত ছিল পশ্চিমবঙ্গের অভিযুক্ত শিমুলিয়া ও মুকিমনগর মাদ্রাসা এবং বোরখাঘরের মতো জঙ্গি ডেরায়। বাংলাদেশের ত্রিশালে যে দুই জঙ্গিকে ছিনতাই করা হয়েছিল তার অন্যতম এই সালাউদ্দিন।”

একইভাবে পশ্চিমবঙ্গে জেএমবির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আনোয়ার হোসেন ফারুখকেও (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের জেলে) এনআইএ খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলায় যুক্ত করতে পারেনি প্রমাণের অভাবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।