পশ্চিমবঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে পঞ্চায়েত নির্বাচন, প্রবল সমালোচনা
2018.04.02
কলকাতা

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণায় সমালোচনায় সরব হয়েছেন রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে এটিকে নজিরবিহীন ঘটনা বলে বর্ণনা করেছেন প্রবীণ শ্রমিক নেতারা।
একই সঙ্গে রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন নির্বাচনী প্রক্রিয়া চালু করারও সমালোচনা করেছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা।
রাজ্য নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের যে নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেছে তাতে তিন দফার নির্বাচনের প্রথম দফায় নির্বাচন হবে ১ মে। অথচ এদিনটি সারা বিশ্বে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ভারতসহ বহু দেশেই এই দিনটি সরকারিভাবে ছুটির দিন।
ভারতের প্রবীণ শ্রমিক নেতা বাসুদেব আচার্য বেনারকে বলেন, “এই দিনটিতে সারা বিশ্বে শ্রমিকেরা মিছিল সমাবেশ করে আগামী দিনের আন্দোলনের শপথ নেন। স্মরণ করেন শহীদদের।”
“এমন একটি দিনে নির্বাচনের দিন ঘোষণার কোনো নজির নেই। রাজ্য সরকারের এটি একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ”, বলেন সেন্টার অব ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নস(সিটু)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট বাসুদেব আচার্য।
অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ট্রেড ইউনিয়ন সেন্টারের সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অচিন্ত্য সিংহ বেনারকে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক মে দিবসকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। অথচ সেই রাজ্যের সরকারই এই দিনে ভোটের ব্যবস্থা করে খুবই নিন্দনীয় কাজ করেছে। শ্রমিক শ্রেণির ওপরই প্রকৃতপক্ষে আঘাত হেনেছে এই সিদ্ধান্ত।”
সরকারের সুপারিশে নির্বাচনে দিন ঘোষণা
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্র কুমার সিং গত ৩১ মার্চ আচমকাই ১ মে থেকে তিন দফায় পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঘোষণা দেন। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়।
নিয়ম অনুয়ায়ী রাজ্য সরকারের সুপারিশ অনুসারেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেছে। তবে একই দিনে নির্বাচনের সুপারিশ এবং কমিশনের ঘোষণা এই প্রথম বলে সাংবাদিকদের বলেন বিজেপি নেতা মুকুল রায়।
রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্র কুমার সিং সাংবাদিকদের বলেন, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তিন দফায় রাজ্যের ২০ টি জেলার মিউনিসিপ্যাল এলাকা বাদে গ্রামীণ এলাকায় ৫৮হাজার ৬৯২টি আসনে পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোট দেবেন ৫ কোটি ৮ লক্ষ ভোটার।
ঘোষিত নির্ঘণ্ট অনুযায়ী, ১ মে প্রথম দফায় ১২টি জেলায়, দ্বিতীয় দফায় ৩ মে ২টি জেলায় এবং তৃতীয় দফায় ৫ মে উত্তরবঙ্গের ৬টি জেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলায় এই নির্বাচন হচ্ছে না।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক প্রশাসনিক সভায় বলেছিলেন, জুলাই-আগস্ট মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে। অথচ আচমকা মে মাসেই নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় পশ্চিমবঙ্গের সব কটি রাজনৈতিক দল অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। যে নির্ঘণ্ট ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে পঞ্চায়েত নির্বাচন নির্বিঘ্নে হবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিরোধী নেতারা।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্কসবাদী (সিপিআইএম) দলের বিধানসভার পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “গত বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) নির্বাচন কমিশনের ডাকা সর্বদল বৈঠকে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট নিয়ে নির্বাচন কমিশনার কোনো ইঙ্গিত দেননি। তাকে জানানো হয়েছিল যে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন যেন নির্বাচনের ঘোষণা না দেওয়া হয়। অথচ দুদিনের মাথায় তড়িঘড়ি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। আসলে শাসক দলকে সুবিধা করে দিতেই এই ঘোষণা।”
সাধারণভাবে যেখানে নির্বাচনে বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে নির্বাচন হওয়া পর্যন্ত ৩৫-৪০ দিনের ব্যবধান রাখা হয় এবার তা রাখা হয়নি বলে জানিয়েছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ নির্ঘণ্ট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করতেই পরীক্ষা চলাকালীন নির্বাচনের নির্ঘন্ট ঘোষণা করা হয়েছে।
সুজন চক্রবর্তী বলেন, “পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে সাড়ে ৫৮ হাজার প্রার্থীর মনোনয়ন পেশ করার কথা। কিন্তু এত অল্প সময় অতীতে কখনো বরাদ্দ করা হয়নি।”
ফলে বিরোধীদের পক্ষে প্রার্থী বাছাই করে মনোনয়ন পত্র দাখিল করা যে কষ্টসাধ্য ব্যাপার তা জানান রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “নির্বাচনের যে নির্ঘণ্ট তৈরি করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক।”
তিনি বলেন, “৫০ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার লক্ষ্যে এই নির্ঘণ্ট তৈরি করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের যে অবস্থা তাঁদের পক্ষে এত অল্প সময়ে সব আসনে প্রার্থী দেওয়া সম্ভব নয়। শাসক দল সেই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চেয়েছে।”
তিনি বলেন, “বর্তমান সব বোর্ডের মেয়াদ আগস্ট পর্যন্ত রয়েছে। সেখানে এত আগে নির্বাচন করে জয়ী বোর্ডকে কী কাজে লাগানো হবে সেটাই প্রশ্ন।”
“আসলে এই মবিলাইজেশন পিরিয়ডে অন্য দলের জয়ী প্রার্থীকে ভাঙিয়ে এবং নির্দল ও বিক্ষুব্ধ জয়ী প্রার্থীদের দলে টানার কাজটি চালানো হবে,” বলেন তিনি।
পঞ্চায়েতের তিন স্তর
স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসনের লক্ষ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্তরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে ভারতে চালু হয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। তৈরি হয় বিধি।
পঞ্চায়েত দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পশ্চিমবঙ্গে ২০ টি জেলা পরিষদের আসনসংখ্যা ৮২৫। এ ছাড়া ৩৪১টি পঞ্চায়েত সমিতির আসনসংখ্যা ৯২১৭ এবং ৩৩৫৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতের আসনসংখ্যা ৪৮৬৫০টি।
“এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই তৃণমূল স্তরে উন্নয়নকাজ পরিচালনা করেন,” বেনারকে বলেন রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
তিনি বলেন, “গত সাত বছরে রাজ্যে যে উন্নয়নের কাজ হয়েছে তা ঐতিহাসিক। এই উন্নয়নের জোয়ারেই তৃণমূল কংগ্রেস সব আসনে জয়ী হবে।”
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, "কিছুদিন আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভারতের মধ্যে তৃতীয় সর্বোত্তম স্থানে ছিল। কিন্তু এখন স্বায়ত্ত শাসনের বিষয়টিকে অবহেলা করে রাজ্য প্রশাসনের অঙ্গ করে ফেলা হয়েছে রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে।”
অবশ্য এ সত্ত্বেও গ্রাম বাংলায় যে উন্নয়নের কাজ হয়েছে সেকথাা স্বীকার করেন তিনি।
অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি
২০১৩ সালে নির্বাচন সূচি এবং নির্বাচন পরিচালনায় কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের মতবিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আদালতের নির্দেশে ৫ দফায় ভোট হয়েছিল এবং ২০ হাজার কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছিল নির্বাচন পরিচালনার কাজে।
এবার অবশ্য রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনো বিরোধ তৈরি না করে বরং বশ্যতা স্বীকার করে কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেন বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু।
তিনি বলেন, “নির্বাচন পরিচালনায় প্রতিটি বুথে দেওয়ার মতো রাজ্যে তো পর্যাপ্ত পুলিশই নেই।”
“নির্বাচন কমিশনারের ডাকা সর্বদল বৈঠকে সব বিরোধী দলের নেতারা নির্বাচনকে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগের দাবি জানিয়েছিলেন”, বেনারকে বলেন কংগ্রেস নেতা মনোজ চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া এই নির্বাচন প্রহসন হতে বাধ্য। সর্বশেষ পুরসভা নির্বাচনেই দেখা গেছে রাজ্য পুলিশের সামনেই শাসক দল কীভাবে গায়ের জোরে ভোট লুট করেছে।”
তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা চাই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হোক। কেন্দ্রীয় বাহিনী আনবে কি না, সেটা নির্বাচন কমিশনের বিষয়। আমরা নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না। করা উচিতও নয়। গণতন্ত্রকে গণতন্ত্র দিয়েই মোকাবিলা করতে হয়। স্বৈরতন্ত্র দিয়ে নয়।”