পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা

পরিতোষ পাল
2018.04.13
কলকাতা
মনোনয়ন জমা দিতে বাধা দানের প্রতিবাদে কলকাতায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে প্রদেশ কংগ্রেসের বিক্ষোভ সমাবেশ। মনোনয়ন জমা দিতে বাধাদানের প্রতিবাদে কলকাতায় রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সামনে প্রদেশ কংগ্রেসের বিক্ষোভ সমাবেশ। ১০ এপ্রিল ২০১৮।
বেনারনিউজ

আইনী জটিলতায় আগামী ১ মে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়া নিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন আইনজীবী ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। নির্বাচনের ওপর কলকাতা হাইকোর্টের অন্তবর্তীকালীন স্থগিতাদেশ চ্যালেঞ্জ করে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে শুনানীর যে আবেদন করেছিল তা শুক্রবার খারিজ হওয়ায় এই পরিস্থিতির আশঙ্কা তাঁদের।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, সরকারের নানামুখী হস্তক্ষেপ এবং মনোনয়ন জমা দেবার ক্ষেত্রে শাসক দলের সশস্ত্র বাধা দেওয়ায় সুরাহার দাবিতে বিরোধীপক্ষ আইনের আশ্রয় নেয়।

বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দার ও অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছেন, সব পক্ষকে নোটিশ দেওয়ার পর সোমবার শুনানী হবে। একই দিনে নির্বাচন সংক্রান্ত মামলার শুনানী হবে বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের একক বেঞ্চেও।

“পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে লড়াই আদালতে গড়ানোয় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তাই পয়লা মে নির্বাচন করা একরকম অসম্ভব,” বেনারকে বলেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী কেশব ভট্টাচার্য্য।

তিনি বলেন, “সোমবার পরবর্তী শুনানীর পর দেওয়া রায়ে বিচারপ্রার্থীরা সন্তুষ্ট না হলে মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীও একই মত পোষণ করে বেনারকে বলেন, “নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আদালত ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দেওয়ায় এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ঘোষিত সূচি অনুযায়ী ১ মে নির্বাচন হচ্ছে না।”

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি অবশ্য কলকাতা হাইকোর্টের অন্তবর্তী আদেশকে স্বাগত জানান। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্কসবাদীর রাজ্য সম্পাদক সূর্য্যকান্ত মিশ্র বলেন, “রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা ও কমিশনের কাজে সরকারের চাপ—এর কোনও কিছুই আদালত অনুমোদন দেয়নি।”

ভারতীয় জনতা পার্টির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের অন্তবর্তী নির্দেশে প্রমাণিত হয়েছে, মনোনয়ন প্রক্রিয়া সঠিক হয়নি।”

তবে তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের রায়ে যারা উল্লাস করছেন, তাদের দুঃখের দিন আসছে। এখন যারা উল্লসিত হচ্ছেন, ভোট হলে দেখা যাবে তারা উল্লাস থেকে পিছিয়ে গেছেন।”

গত ২ এপ্রিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন জানায় ১, ৩ ও ৫ মে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ২০১৩ সালে শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল।

গত ৯ এপ্রিল ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বামপন্থী দলগুলির দায়ের করা দুটি পৃথক মামলার শুনানীতে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে মনোনয়ন পত্র দা​খিলের সময় একদিন বাড়িয়ে ১০ এপ্রিল ঠিক করা হয়।

তবে রাজ্য সরকারের একজন বিশেষ সচিব এবং তৃণমূল কংগ্রেসের আইনজীবী সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ১২ ঘন্টার মধ্যে ১০ এপ্রিল সকালে কমিশন সেই বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করে নেয়।

এই প্রত্যাহারকে চ্যালেঞ্জ করে গত বৃহষ্পতিবার ভারতীয় জনতা পার্টি, ১৭টি বাম দল এবং কংগ্রেস কলকাতা হাইকোর্টে নতুন করে মামলা করে। বুধবার সুপ্রিম কোর্টে ভারতীয় জনতা পার্টি ও বামপন্থীরা ফের আবেদন করলে আদালত কলকাতা হাইকোর্টে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

এর আগে ভারতীয় জনতা পার্টির দায়ের করা মামলায় সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করবে না জানালেও তাঁদের পর্যবেক্ষণে বিচারপতিরা বলেন, কেউ যদি নির্বাচনে লড়তে চান, তাহলে সেটা তাঁর সাংবিধানিক অধিকার। সেই পথকে নিষ্কণ্টক করা কমিশনের দায়িত্ব।

গত বৃহষ্পতিবার বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের একক বেঞ্চ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অন্তবর্তী স্থগিতাদেশ জারি করে ১৬ এপ্রিল পরবর্তী শুনানীর নির্দেশ দেন। বিচারপতি কমিশনকে সোমবারের মধ্যে হলফনামা দিয়ে ৯ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত কতজন মনোনয়ন দিতে চেয়ে আবেদন করেছেন বা কতজন অভিযোগ করেছেন—এ সংক্রান্ত সব তথ্য জানাতে বলেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেস অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠায় বিরোধীরা আইনি লড়াই করে কিছু আদায় করার মনোবল অর্জন করে। তবে যেভাবে পেশিশক্তি ও অর্থের জোরে বিরোধীদের মনোনয়ন আটকানো হযেছে, সে ভাবেই গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হবে।”

গত ২ এপ্রিল মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে শাসকদলের কর্মীরা বিরোধীদের বহু জায়গাতেই মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি। প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকদের মারধর করা হয়েছে।

ভারতীয় জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, মনোনয়ন পত্র জমা দেবার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে ১ হাজার ৪৩১টি সংঘর্ষ ও বিরোধী প্রার্থীদের মারধরের ঘটনা ঘটেছে।

বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু সাংবাদিকদের বলেন, তাঁদের কাছে ৭০টি বড় ধরনের গোলমালের তথ্য রয়েছে। আর নির্বাচনের নামে প্রহসন তৈরির চেষ্টার প্রতিবাদে বামদলগুলি শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ১২ পর্যন্ত বনধ কর্মসূচি পালন করে বলে বসু সাংবাদিকদের জানান।

কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্কসবাদীর পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে অরাজকতা তৈরি করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে সকলের সরব প্রতিবাদ হওয়া দরকার।

তবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনোনয়ন পর্বে হিংসার কথা মানতেই চাননি। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “৫৮ হাজার বুথের মাত্র ৭টি তে গোলমালের ঘটনা ঘটেছে।” তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মিথ্যা, কুৎসা ও অপপ্রচারের বেসাতি চলছে।

বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়

ব্যাপক সন্ত্রাসের ফলেই যে বিরোধীরা সব আসনে মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি সেটা নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্যে স্পষ্ট বলে জানিয়েছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।

আগের সূচি অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া পর্যন্ত প্রায় ৪০ শতাংশ আসনে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে চলেছে।

বীরভূম জেলায় জেলা পরিষদের ৪২টি আসনের ৪১টিতেই তৃণমূল কংগ্রেস বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। বিজেপির একজন প্রার্থী থাকলেও তিনিও নাম প্রত্যাহার করে নিযেছেন। একই ছবি বাঁকুড়া জেলাতেও।

বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, পরিকল্পনামাফিক রেকর্ডসংখ্যক আসনে শাসক দল জয়ী হয়েছে। অতীতে এমন নজির নেই। একমাত্র ২০০৩ সালে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৩ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ১০.৬৬ শতাংশ প্রার্থী।

পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর হলো, গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৮ হাজার ৬৫০টি আসনের মধ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি মনোনয়ন জমা দিয়েছে ২৭ হাজার ৯৯টি আসনে। আর বামদলগুলি জমা দিযেছে ১৮ হাজার ৬১২টি আসনে। অথচ তৃণমূল কংগ্রেস মনোনয়ন জমা দিযেছে ৫৮ হাজার ৪৯০টি আসনে। পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের ক্ষেত্রেও চিত্রটি একই। সবক্ষেত্রেই শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে আসন সংখ্যার চেয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সংখ্যা অনেক বেশি।

বিজ্ঞজনের প্রতিবাদ

পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্বে রাজ্যে যে সহিংসতা দেখা গেছে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা।

রাজ্যের সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, জোর করে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা না দিতে দেওয়া, মারধর করা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের মাধ্যমে যে ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে তা কার্যত বিকলাঙ্গ গণতন্ত্র।

সঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় বেনারকে বলেন, “এক সময় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আমরা পরিবর্তনের কথা বলেছিলাম। এখন আবার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হচ্ছে আমাদের।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।