এক দিনে পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত নির্বাচন, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

পরিতোষ পাল
2018.04.27
কলকাতা
প্রাক নির্বাচনী পর্বে রাজ্য জুড়ে শাসক দলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে কলকাতায় বামপন্থী দলগুলোর প্রতিবাদ মিছিল। প্রাক নির্বাচনী পর্বে রাজ্য জুড়ে শাসক দলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে কলকাতায় বামপন্থী দলগুলোর প্রতিবাদ মিছিল। ২৫ এপ্রিল ২০১৮।
বেনারনিউজ

আদালতের চাপে পঞ্চায়েত নির্বাচন বিষয়ে আলোচনার জন্য শুক্রবার ১০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শনিবার বৈঠক করতে চেয়ে জরুরি ভিত্তিতে চিঠি পাঠিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশন।

শুক্রবার আদালত নির্বাচন কমিশনের কাছে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নিরাপত্তা প্রস্তুতি ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার তথ্য জানতে চায়।

এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ সাংবাদ সম্মেললন করে জানান, “পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা প্রতিটি বুথে সশস্ত্র পুলিশের ব্যবস্থা করছি। এ জন্য চার–পাঁচটি রাজ্যের কাছ থেকে সশস্ত্র পুলিশ আনার জন্য কথা চলছে।”

রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রয়োজনীয় আলাপ–আলোচনা এবং পর্যাপ্ত পুলিশি বন্দোবস্ত না করেই পশ্চিমবঙ্গে তিন স্তরে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নতুন তফশিল ঘোষণা করায় প্রবল আপত্তি জানায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো।

সরকারি কর্মী পরিষদ নামে রাজ্য সরকারি কর্মী সংগঠনের পক্ষ থেকে শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টে আসন্ন নির্বাচনে নিরাপত্তার প্রশ্নে আবেদন করা হয়।

এরই প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা প্রস্তুতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার তথ্য জানতে চায় আদালত।

বৃহস্পতিবার রাজ্যের পঞ্চায়েত দপ্তর নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচনের দিন ঠিক করে বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর পরেই কমিশন আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে ১৪ মে এক দফায় রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন করার কথা বলা হয়।

এর আগে গত ৩১ মার্চ নির্বাচন কমিশন প্রথম ১, ৩ ও ৫ মে তিন দফায় নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে। কিন্তু মনোনয়ন পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকে শাসক দলের বাধায় মনোনয়ন পত্র জমা দিতে না পারার অভিযোগে বিরোধী দলগুলো আদালতের দ্বারস্থ হয়।

বিরোধীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত প্রথমে নির্বাচন প্রক্রিয়া স্থগিত এবং পরে অতিরিক্ত একদিন মনোনয়নের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেয়।

একদিনে নির্বাচন, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

নতুন তফশিল অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন একদিনে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তে নিরাপত্তা বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতা অশোক ঘোষ বেনারকে বলেন, “রাজ্যে এক দিনে নির্বাচন করার সাহস সাম্প্রতিককালে কোনও নির্বাচন কমিশন দেখায়নি। সরকারের অনুগত হয়েই কমিশন এটা করেছে।”

ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, “মনোনয়ন পর্বের শুরু থেকেই শাসক দল সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিরোধীদের মনোনয়নে বাধা দিয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা না করেই নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে নতুন তারিখ ঘোষণা করে।”

তবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সচিব নীলাঞ্জন শান্ডিল্য সাংবাদিকদের বলেন, “আলোচনার ভিত্তিতেই দিন ঠিক হয়েছে। রমজান মাস, বর্ষা সবকিছু বিবেচনায় রাখা হয়েছে।”

তবে “নিরাপত্তার ব্যাপারটি রাজ্য সরকার দেখবে’” বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজ্য পুলিশ কর্তাদের মতে, পঞ্চায়েত নির্বাচনে মোট ৫৮ হাজার ৪৬৭টি বুথ থাকলেও ভোট কেন্দ্র রয়েছে ৪৩ হাজার ৮৭টি। ফলে প্রতি ভোটকেন্দ্রে সশস্ত্র পুলিশ দিতে অসুবিধা হবে না। রাজ্য পুলিশ রয়েছে ৪৬ হাজার। কলকাতা পুলিশ রয়েছে ১২ হাজার। এ ছাড়া কারারক্ষী, বনরক্ষীসহ অন্যদের সহযোগিতা নেওয়া হবে।

এদিকে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের দিন রাজ্যজুড়ে অঘটনের আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু।

একই অভিমত বামপন্থী নেতা অশোক ঘোষেরও। তিনি বলেন, “প্রাক নির্বাচনী সহিংসতা থেকে স্পষ্ট যে, শাসক দল দুর্বৃত্তায়নের যে ব্যবস্থা কায়েম করেছে তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া কঠিন।”

বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু বলেন, “প্রতি বুথে একজন সশস্ত্র পুলিশ থাকাই কি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে যথেষ্ট? ভোটারদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে কে? আমরা তাই কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি জানিয়েছি।”

সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, “স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর অনুযায়ী সশস্ত্র পুলিশ একজন দেওয়া যায় না। প্রতি বুথে কমপক্ষে দুজন সশস্ত্র পুলিশ দিতে হয়। এ ছাড়াও উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশেষভাবে তৈরি রাখতে হয় পুলিশ বাহিনীকে।”

২০১৩ সালের শেষ পঞ্চায়েত নির্বাচনেও রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়াই নির্বাচন করতে চেয়েছিল। তবে তৎকালীন নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ৩৫ হাজার সদস্যের ব্যবস্থা করেছিল। সেবার নির্বাচন হয়েছিল পাঁচ দফায়।

এদিকে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবারও কমিশন সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য অতিরিক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রস্তাব দেয়। কিন্তু রাজ্য সরকার তা মানতে চায় নি।

তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মনোনয়নপর্ব শুরু হওয়ার পর রাজ্যে সহিংসতার বলি হয়েছেন পাঁচজন।

এ প্রসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক অঞ্জন বেরা বেনারকে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকার পঞ্চায়েতের বহুত্ববাদি চরিত্রকে পুরোপুরি ধ্বংস করার ব্যবস্থা করেছে। শাসক দল ছাড়া কাউকেই পঞ্চায়েতে প্রতিনিধিত্ব করতে দিতে তারা রাজি নয়।”

তবে নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারির পর সাংবাদিকদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গণতন্ত্র অনুযায়ী অন্তত নির্বাচনটা হোক। আমরা চাই, শান্তিপূর্ণভাবে ভোটের কাজ সম্পন্ন হোক।”

এদিকে একদিনে নির্বাচন হলে প্রয়োজনীয় নির্বাচনী কর্মী পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে অধ্যাপক পরিমল কর বেনারকে বলেন, “বুথ পিছু পাঁচজন কর্মী প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ একদিনে পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য লাগবে প্রায় পৌনে তিন লাখ কর্মী। এতো সংখ্যক কর্মী পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।