পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের একাধিপত্য বহাল
2018.05.17
ঢাকা

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে একাধিপত্য বজায় রেখেছে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস। জেলা পরিষদের ৯৯ শতাংশ, পঞ্চায়েত সমিতির ৯০ শতাংশ এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের ৭৩ শতাংশ আসনে শাসক দল জয়ী হতে চলেছে।
বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ফলাফল থেকেই এই তথ্য জানা গেছে।
এমন ফল প্রত্যাশিতই ছিল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনী সমীক্ষাতেও একই ইঙ্গিত দেওয়া হয়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এদিন রাতে সাংবাদিকদের বলেন, “বিরোধীদের জোট হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস ৯০ শতাংশ আসনে জয়ী হয়েছে। এই জয় মানুষের জয়। এই জয় বুঝিয়ে দিয়েছে তৃণমূল স্তরে আমরা কতটা শক্তিশালী।”
ফলাফল
এদিন রাত পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের জেলা পরিষদের ৬২১টির মধ্যে ৩৫১ আসনেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ৯ টিতে জয়ী হয়েছে বিজেপি এবং ২টিতে বামফ্রন্ট ও ৫টিতে কংগ্রেস। পঞ্চায়েত সমিতির ৬,১২৩টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস জয় লাভ করেছে ৪,০৩৬টি আসনে। অন্যদিকে বিজেপি পেয়েছে ৫৩৬টি আসন, বামরা পেয়েছে ১০২টি, কংগ্রেস পেয়েছে ৮৪টি এবং নির্দল ও অন্যান্যরা পেয়েছে ৮৬টি আসন।
গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩১,৭৮৯টি আসনের মধ্যে শাসক দল পেয়েছে ২১,৪৪১, বিজেপি ৫,১৯২, বামরা ১,৪২৬, কংগ্রেস ৯৪৪ এবং নির্দল ও অন্যান্যরা পেয়েছে ১,৭০৮টি আসন।
বেশ কিছু আসনে এদিন রাত পর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন।
মোট ৪৮ হাজার ৬৫০টি আসনের মধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৬ হাজার ৮১৪টি আসনে, পঞ্চায়েত সমিতির ৩ হাজার ৫৯টি আসনে এবং জেলা পরিষদের ২০৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
বিরোধীদের অভিযোগ অব্যাহত
বহু আইনি জটিলতার মধ্যে গত ১৪ মে এক দফায় পশ্চিমবঙ্গের ২০টি জেলায় ৩৮ হাজার ৫৪৬ টি আসনে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকার এই নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে জানালেও বিরোধীরা নির্বাচনের দিন ব্যাপক সন্ত্রাসের অভিযোগ করেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই সন্ত্রাসে উদ্বেগ প্রকাশ করে গত মঙ্গলবার মন্তব্য করেন, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে।
এবারের এই নবম পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন পর্বে ১৯ জন এবং নির্বাচনের দিন ও পরবর্তী সময়ে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে।
বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতা অশোক ঘোষ বেনারকে বলেন, “নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। তাই জয় পরাজয়ের হিসাবে কিছু আসে যায় না।”
তিনি বলেন, “মনোনয়ন পর্ব থেকে যে সন্ত্রাস শুরু হয়েছে তাতে বিরোধীরা বহু আসনেই মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি। আর এরই সুযোগ নিয়ে ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দল জয়ী হয়েছে।”
আদালতের নির্দেশে অবশ্য এই ৩৪ শতাংশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীদের ভবিষ্যৎ ঝুলে রয়েছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অঞ্জন বেরা বেনারকে বলেন, “রাজ্যে যে স্বৈরতন্ত্র চলছে তাতে শাসক দলের সন্ত্রাস এখানেই থেমে থাকবে না। এবার জয়ী বিরোধী প্রার্থীদের ওপর চলবে লাগামছাড়া অত্যাচার।”
গণমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ভোট গণনার দিনেও নানা জায়গায় অশান্তি হয়েছে। অনেক জায়গাতেই বিরোধী এজেন্টদের গণনাকেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কোথাও কোথাও তাঁদের মেরে বার করে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের এক আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার সূত্রে বলেন, “নদীয়ার মাজদিয়ায় একটি গণনা কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। কমিশন সংশ্লিষ্ট ২টি বুথের গণনা স্থগিত করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে রিপোর্ট তলব করেছে।”
ফলাফলের ইঙ্গিত
“রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল থেকে স্পষ্ট হয়েছে, যেখানেই ভোট দেওয়ার সুযোগ হয়েছে সেখানেই বহুত্ববাদী রাজনীতির উপস্থিতি দেখতে পাওয়া গেছে,” বলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, “শাসক দলের জয় নিশ্চিত সত্ত্বেও তারা বিরোধীদের জন্য পরিসর তৈরির কোনো সুযোগই দেয়নি।”
বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, “এবারের ফলাফলে বাম ও কংগ্রেসকে অনেক পেছনে ফেলে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দ্বিতীয়স্থানে উঠে আসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আদিবাসীরা যে এবার বিজেপিকেই ভোট দিয়েছে তা স্পষ্ট হয়েছে জঙ্গল মহল বলে পরিচিত ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার বড় অংশ এবং উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জেলার ফলে।”
তাঁর মতে, “ব্যাপক সংখ্যক নির্দল প্রার্থীর জয়ও এবার নজর কেড়েছে। এই নির্দলদের অধিকাংশই অবশ্য শাসক দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে প্রার্থী হয়।”
অঞ্জন বেরা অবশ্য মনে করেন, “ধর্মীয় মৌলবাদ ও স্বৈরচারী শক্তি নিজেদের মতো করে পরিসর বাড়াচ্ছে। এদের সামাজিক ভিত্তিও এক।”
তিনি বলেন, “সামাজিক বিভাজন ও রাজনৈতিক হিংসা বাড়ছে। সামগ্রিকভাবে যুক্তি, বুদ্ধি এবং গণতন্ত্রকে প্রবলভাবে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে।”
জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী বেনারকে বলেন, আমরা রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করে রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারির দাবি জানিয়েছি।”
“রাজ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে জরুরি অবস্থা জারি ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই,” বলেনি তিনি।
ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি দিলীপ ঘোষ অবশ্য দলের ফলে মোটামুটি খুশি। তিনি বলেন, “আরও লড়াই করার সুযোগ পেলে বিজেপি আরও ভালো ফল করত। আগামী দিনে আরও নির্বাচন হবে। তখন দেখা যাবে।”