পশ্চিমবঙ্গে ‘বালি মাফিয়া’দের পেছনে রাজনৈতিক দল

পরিতোষ পাল ও ঝুমুর দেব
2017.05.10
কলকাতা ও গৌহাটি, ভারত
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর থানার দরবারপুর গ্রামে বোমা বানাতে গিয়ে আট জন নিহত ও চারজন আহত। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার দরবারপুর গ্রামে বোমা বানাতে গিয়ে আট জন নিহত ও চারজন আহত হন। এপ্রিল ২১, ২০১৭।
বেনারনিউজ

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের দরবারপুর গ্রামের একটি বাড়িতে গত ২১ এপ্রিল বোমা বিস্ফোরণে নিহত নয় জনের একজন হাসিনার স্বামী বাবর আলী (৩১)। পুলিশ জানায়, ৮০টি নদী থেকে অবৈধ বালি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন দলের মধ্যে চলমান সহিংসতার অংশ হিসেবে বাবর বোমা বানানোর কাজে জড়িত ছিলেন।

এই ঘটনায় নয়জনের মৃত্যু পশ্চিমবঙ্গের চলমান রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সংঘাতের ঘটনাগুলোর মাত্র একটি উদাহরণ।

“তারা [পুলিশ] বলছে আমার স্বামী বালি মাফিয়াদের সাথে যুক্ত ছিল। তাহলে তারা কেন খোলাখুলিভাবে এই মাফিয়া নেতাদের নাম বলছে না?” বেনারকে বলেন হাসিনা, যিনি ‘রাজনীতি সম্পৃক্ত’ মূল অপরাধীদের আড়াল করার জন্য পুলিশকে অভিযুক্ত করেছেন।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ স্বীকার করেছে যে, রাজনৈতিক চাপের কারণে অবৈধ বালি বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ঘটা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বছরে এই বালি বাণিজ্যের পরিমাণ ১২ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি।

“এই অবৈধ বালি খনিগুলির একটি বড় অংশ শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থিত লোকজনের নিয়ন্ত্রণে, আর কিছু আছে বিরোধীদলীয় সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে। রাজনৈতিক চাপের কারণে আমাদের পক্ষে কিছু করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে,” নাম প্রকাশ না করা শর্তে বেনারকে বলেন বীরভূম পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

সহিংসতা: রাজ্যের রাজনৈতিক ‘বৈশিষ্ট্য’
অবৈধ বালি-খনির ব্যবসা ঘিরে সহিংসতা পশ্চিমবঙ্গে গত চার দশক ধরে চলমান প্রাণঘাতী রাজনৈতিক সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাসেরই উত্তরাধিকার বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এ প্রসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক সমীর কুমার দাস বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়।”

তাঁর মতে, এই সহিংসতার সূচনা পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এর ৩৪ বছরের শাসনামলে, যা ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরও অব্যাহত রয়েছে।

“বহু বছর ধরে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্যটাই হয়ে উঠেছে সহিংসতা। বিরোধীদের দমন করার জন্য ক্ষমতার তিন দশক ধরে সিপিআই-এম সহিংসতাকে ব্যবহার করেছে। আর এখন তৃণমূলও একই পদচিহ্ন অনুসরণ করছে,” বলেন সমীর কুমার দাস।

তিনি বলেন, “এটা খুবই উদ্বেগের কারণ যে, এই রাজনৈতিক দলগুলো যাদের সুরক্ষা দেবার কথা, ক্ষমতার জন্য সেইসব নিরপরাধ মানুষের জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শুধু চলতি বছর পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের মাঝে সহিংসতার প্রায় ৫০টি ঘটনা ঘটেছে। যদিও এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তের কোনো পরিসংখ্যান নেই।

গত রোববার বর্ধমানে তৃণমূলের একটি অফিস ভবনে বোমা বিস্ফোরণে কমপক্ষে একজন নিহত ও তিনজন গুরুতর আহত হন।

দি হিন্দু পত্রিকা জানায়, স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশ নিহতদের সংখ্যা কমিয়ে দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, বিস্ফোরণের পর পর তৃণমূলের কর্মীরা কিছু মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে।

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

কলকাতা থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে পিচকুদিজাল গ্রামে তৃণমূলের অফিসে হামলার জন্য তৃণমূল তার প্রধান বিরোধী দল সিপিআই-এমকে দায়ী করেছে।

“সিপিআই-এম কর্মীরা মোটরসাইকেলে করে এসে টিএমসি অফিসে বোমা হামলা চালায়। তারা গ্রামাঞ্চলে নিয়মিতভাবে তৃণমূল কর্মীদের ওপর হামলা করছে,” বেনারকে বলেন তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল।

অন্য দিকে এই ঘটনার জন্য বিরোধী দল দায়ী করছে তৃণমূলকে। এ প্রসঙ্গে সিপিআই-এম এর সুজন চক্রবর্তী বেনারকে বলেন, “ক্ষমতাসীন দল নিরীহ মানুষকে বোমা বানাতে বাধ্য করছে। তৃণমূলের কর্মীরা বরাবরই সঠিক সংখ্যা আড়াল করার জন্য বিস্ফোরণস্থল থেকে মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে।”

তবে তৃণমূল দলীয় সংসদ সদস্য ফিরহাদ হাকিম এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “রাজ্যে কোনো সহিংসতার সাথেই ক্ষমতাসীন দলের কোনো সম্পর্ক নেই।”

তিনি বেনারকে বলেন “আমরা বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি এবং এখনও পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সমর্থন রয়েছে আমাদের সাথে। বোমা তৈরিতে বাম দলের (সিপিআইএম) কর্মীরা জড়িত। তারা সহিংসতা ঘটিয়ে আমাদের ওপর দায় চাপিয়ে সরকারের ইমেজ ধ্বংস করতে চাচ্ছে।”

এদিকে রাজনীতিবিদরা যখন কোনো দায়িত্ব নেন না তখন ফাতেমা বিবির মতো গ্রামের মানুষকে ভয়ের মধ্যেই জীবন যাপন করতে হয়।

ফাতেমা জানান, বীরভূমের দরবারপুরে গত ২১ এপ্রিল বিস্ফোরণের ঘটনার পর তার স্বামীসহ গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ বাড়িছাড়া।

“যখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে তখন পুলিশ এসে গ্রামের যাকে তাকে গ্রেফতার করে কাগজেপত্রে দেখিয়ে দেয় যে তারা দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের তারা গ্রেফতার করে না,” বেনারকে বলেন ফাতেমা।

প্রায় একই রকম কথা বলেছেন বীরভূমের আরেক বাসিন্দা সুন্দর কুণ্ডু (৪১)।

“পশ্চিমবঙ্গে রক্তারক্তি দিনে দিনে আরো ভয়ংকর হচ্ছে। পার্টি বিরোধীতার নামে, দলগুলো একজন আরেকজনের ওপর বোমা মারছে। পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। দিনে দিনে গ্রামের মানুষ বলির পাঁঠাতে পরিণত হচ্ছে,” বেনারকে বলেন কুণ্ডু।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।