পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন ঘিরে হিংসার বলি ১০
2018.08.30
কলকাতা

গ্রামীণ পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনকে ঘিরে রাজনৈতিক হিংসায় ১০ জন নিহত হওয়ার ঘটনা অসুস্থ রাজনীতির ফল বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “খুন-সন্ত্রাস কোনো কোনো দলের কাছে এখন মডেল। পরিকল্পনা করে এগুলো করা হচ্ছে।”
গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও বোমা-গুলিতে বিভিন্ন জেলায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ৫০ জনেরও বেশি। বৃহস্পতিবারও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
বিরোধীরা দাবি করেছে, বিরোধীশূণ্য পঞ্চায়েত করার জন্য মরিয়া হয়ে তৃণমূল কংগ্রেস প্রশাসনের মদদে পরিকল্পিতভাবে হামলা করছে৷
পশ্চিমবঙ্গের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বেনারকে বলেন, “রাজ্যের অধিকাংশ স্থানেই শান্তিপূর্ণভাবে গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠন করা সম্ভব হয়েছে। কয়েকটি জায়গায় গোলমাল হয়েছে। সেগুলোকে বিরোধীরা বড় ঘটনা হিসেবে তুলে ধরছে।”
মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সাংবাদিকদের বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেসের হাত ধরে হিংসার রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে গভীর শিকড় তৈরি করেছে। পঞ্চায়েতের উন্নয়নের কাজকর্ম ছাড়িয়ে দখলদারি আর হিংসাই এখন বড় কথা।”
রাজ্যের ৩১৪৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনের সময়সীমা শেষ হয়েছে গত বুধবার। রাজ্য পঞ্চায়েত দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গড়া হয়েছে। নানা কারণে ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে বোর্ড গঠন হয়নি। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেই সব বোর্ড গঠন স্থগিত রাখা হয়েছে।
এবার শুরু হবে পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদে বোর্ড গঠনের কাজ। সেই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বৈধ বলে ঘোষিত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী আসনেও বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দিয়েছে পঞ্চায়েত দপ্তর।
উল্লেখ্য, এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্বে ২৯ জনের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে সরকারিভাবে বলা হয়। এ হত্যাকান্ডগুলো ঘটেছে মনোনয়ন পর্ব থেকে ভোট দান পর্যন্ত সময়ে।
চার দিনে নিহত ১০
প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বোর্ড গঠনের বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় রাজনৈতিক সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। উত্তর দিনাজপুরে ২ জন, মালদহে ২ জন,পুরুলিয়ায় ২ জন, ঝাড়গ্রামে ১ জন এবং উত্তর ২৪ পরগণায় ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার রাত থেকে উত্তর ২৪ পরগণার আমডাঙ্গায় শাসক ও বিরোধী দলের সংঘর্ষে ব্যাপকভাবে গুলি ও বোমা ব্যবহৃত হয়েছে বলে গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন। এই ঘটনায় ৩ জন নিহত হন। আরও ১০ জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
বৃহস্পতিবারও আমডাঙ্গায় পরিস্থিতি থমথমে। স্কুল বন্ধ। কমব্যাট ফোর্সের টহল চলছে।পুলিশ ইতিমধ্যেই গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা শতাধিক তাজা বোমা ও গুলির খোল উদ্ধার করেছে।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার তৃণমূল কংগ্রেসের পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেন, “মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা নিয়ে পরিকল্পনা করে এই হামলা করে।”
বাংলাদেশ থেকে অস্ত্র আনা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাঁর।
“পশ্চিমবঙ্গ এখন বারুদের স্তূপের ওপর বসে রয়েছে। যা ঘটছে তা ভোট সন্ত্রাসেরই পুনরাবৃত্তি”- বেনারকে বলেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, “বোর্ড গঠন নিয়ে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। খুব বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হয়েছে।”
পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বেনারকে বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেসকে বোর্ড গঠন করা আটকাতে সব বিরোধীরা একজোট হয়ে হামলা করছে।”
অবশ্য ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে এখন যা হচ্ছে তা তৃণমূল কংগ্রেস, মাফিয়া ও পুলিশের জোটের সঙ্গে জনগণের লড়াই। মানুষই তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যব্রত বিশ্বাস বেনারকে বলেন, ”বোর্ড গঠন নিয়ে যেভাবে সংঘর্ষে যথেচ্ছ গুলি-বোমা ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে আগামী দিনগুলিতে রাজ্যের পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছাবে।”
নিরাপত্তার আরজি খারিজ
পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন পর্বে নিরাপত্তার আরজি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে।
একটি মামলায় বুধবার বিচারপতি সুব্রত তালুকদার তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, গ্রাম পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনে সভায় অংশগ্রহণে এবং ভোট দিয়ে বোর্ড গঠন করা বিজয়ী প্রার্থীদের অধিকার।
তবে ভারতীয় জনতা পার্টির করা মামলার দ্রুত শুনানির আবেদন বুধবার খারিজ করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী মামলাটির শুনানি নিয়ম অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান।
ভারতীয় জনতা পার্টির আইনজীবী স্মরজিৎ রায় চৌধুরী বেনারকে বলেন, “অশান্তির আশঙ্কায় জেলায় জেলায় পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন পর্বে বিরোধী প্রার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়ার আরজি জানানো হয়েছিল আদালতে।”
এর আগে অন্য একটি মামলায় বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী উত্তর ২৪ পরগণার আমডাঙ্গার এক গ্রাম পঞ্চায়েতের ১০ জন বিরোধী প্রার্থীকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং তারা যাতে পঞ্চায়েতের বৈঠকে যোগ দিতে পারেন সেই ব্যবস্থা করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।
বোর্ড গঠনে সুবিধাবাদী সমঝোতা
পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনে বহু জায়গাতেই দলের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
“তৃণমূল স্তরে বাস্তব অবস্থার নিরিখে স্থানীয়ভাবে সুবিধাবাদী সমঝোতার নজির অতীতেও দেখা গিয়েছে। তবে এবার শাসক দলকে প্রতিহত করতে বামপন্থীরা যেমন রাজনৈতিক শত্রু ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, তেমনি কংগ্রেস শাসক দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েও বোর্ড গঠন করেছে বলে জানা যাচ্ছে,” বলেন অধ্যাপক বিশ্বাস।
তিনি আরও বলেন, “শাসক দলের বিক্ষুব্ধদের নিয়ে বিরোধীরা বোর্ড তৈরি করেছে এমন নজিরও রয়েছে।”
তবে বিজেপির সায়ন্তন বসু দাবি করেন, “ভারতীয় জনতা পার্টিকে বোর্ড গঠনে অনেক জায়গাতে তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধরাও সমর্থন দিয়েছে। সমর্থন দিয়েছে বাম ও কংগ্রেসও।”
“তৃণমূল কংগ্রেসকে প্রতিহত করতে যারাই ভারতীয় জনতা পার্টিকে বোর্ড গঠনে সমর্থন দিক না কেন, আসলে জনগণই এই সমর্থন দিয়েছে,” বলেন সায়ন্তন বসু।