পশ্চিমবঙ্গ ‘বাংলা’ হচ্ছে

পরিতোষ পাল
2018.07.26
কলকাতা
180726_West_Bengal_1000.JPG পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতার ঐতিহ্যবাহী হাতে টানা রিকশা বা টাঙায় যাত্রী নিয়ে ট্রাম লাইন পার হচ্ছেন একজন চালক। ২৯ জুন ২০১৮।
রয়টার্স

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম বদলে ‘বাংলা’ হচ্ছে। নাম বদলের এই প্রস্তাব সর্বসম্মভাবে বৃহস্পতিবার রাজ্য বিধানসভায় গৃহীত হয়েছে। বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি—এই তিন ভাষাতেই রাজ্যের নাম হবে ‘বাংলা’।

মুখ্যমন্ত্রী এদিন বিধানসভায় জানান, “দু’বছর আগে আমরা সর্বসম্মত হয়ে কেন্দ্রের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম, তিনটি ভাষায় রাজ্যের নাম হোক। কিন্তু ওরা রাজি হয়নি। আমরা অনেকবার অনুরোধ করেছি। কেন্দ্র বলেছিল, একটা ভাষাতেই হোক। তাই আজ সর্বসম্মতভাবে রাজ্যের একটাই নাম করতে চাই, ‘বাংলা’।”

রাজ্য সচিবালয় নবান্ন সূত্রে বলা হয়, এবার এই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পাঠানো হবে। এরপরে বিল আকারে তা সংসদে গৃহীত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ্যের নাম পরিবর্তিত হবে।

এদিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবটি পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পেশ করলে সব দলই প্রস্তাবে সমর্থন জানায়।

তবে পশ্চিমবঙ্গের নতুন নাম প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে বিভ্রান্তি তৈরি করবে বলে মনে করছেন দু’দেশের বিশ্লেষকেরা। এ বিষয়ে এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও আপত্তি এসেছিল।

এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “কিছুটা দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। তবে আমাদের বাংলার সঙ্গে দেশ রয়েছে।”

তাঁর মতে, “আসলে বাংলা বলতে বর্তমান বাংলাদেশকে বোঝায়। বিশেষ করে ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা এসব অঞ্চলই ছিল বাংলা অঞ্চল। পশ্চিমবঙ্গ পরিচিত ছিল রাঢ় বা সৌম্য নামে।”

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বেনারকে বলেন, “আমি বঙ্গ নাম প্রস্তাব করেছিলাম। শুনেছিলাম মুখ্যমন্ত্রী তা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু বাংলা নাম গৃহীত হওয়ায় বিভ্রান্তিই তৈরি করবে প্রতিবেশী দেশের নামের সঙ্গে।”

তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার এই বিভ্রান্তি তৈরির সম্ভাবনার কারণেই অনুমোদন দেবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”

২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট রাজ্য বিধানসভায় রাজ্যের নাম বাংলায় ‘বাংলা’, ইংরাজিতে ‘বেঙ্গল’ ও হিন্দিতে ‘বঙ্গাল’ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরে সেই প্রস্তাব কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু একই রাজ্যের তিনটি নাম হতে পারে না জানিয়ে প্রস্তাব ফেরত পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

সরকারি সূত্রের খবর, আগের প্রস্তাব ফেরত আসার পর ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাজ্য মন্ত্রিসভায় সব ভাষাতেই বাংলা নামের প্রস্তাব গৃহীত হয়।

রাজ্য সরকারের এক আধিকারিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক অবশ্য গত বছরই প্রতিবেশী বাংলাদেশের নামের সঙ্গে বিভ্রান্তি তৈরির অবকাশের কথা জানিয়ে বাংলা নামে আপত্তির কথা রাজ্য সরকারকে জানায়।

বারবার নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব

সরকারি তথ্য মতে, পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনে প্রথম রাজ্য বিধানসভায় বিতর্ক হয়েছিল ১৯৯৯ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে। সেবার বাংলা নামটি প্রস্তাব আকারে গৃহীত হলেও শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি।

এরপর ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের নাম ইংরেজিতে ও বাংলায় ‘পশ্চিমবঙ্গ’ করার প্রস্তাব রাজ্য বিধানসভায় গৃহীত হয়।

কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ায় ২০১৬ সালে ফের রাজ্য বিধানসভায় রাজ্যের নাম বাংলায় ‘বাংলা’, ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’ ও হিন্দিতে ‘বঙ্গাল’ করার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

সরকারের মতে, এই নাম পরিবর্তন জাতীয় স্তরে রাজ্যের স্বার্থ সুরক্ষায় সহায়ক হয়ে উঠবে।

রাজ্যের নাম পরিবর্তনের পেছনে রাজ্য সরকারের যুক্তি, ইংরেজিতে রাজ্যের নাম লেখা হয় ওয়েস্ট বেঙ্গল। ইংরেজি বর্ণমালা অনুযায়ী শেষে থাকায় সাংবিধানিক সংস্থার সঙ্গে রাজ্যের যে কোনো আলোচনায় বক্তব্য পেশের জন্য রাজ্যের প্রতিনিধিদের শেষের দিকে বলার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত সদস্যদের বক্তব্য শোনার ধৈর্য আর থাকে না।

“এই তুচ্ছ যুক্তি দিয়ে রাজ্যের নাম পরিবর্তনের কোনো অর্থ নেই”, বেনারকে বলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার।

নাম নিয়ে বিতর্ক

গত দুই দশকে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে কী রাখা হবে তা নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে।

অনেকে বঙ্গ নামের পক্ষে মত দেন, অনেকে আবার বাংলা নামের পক্ষে মত জানান। আবার তরুণ সাহিত্যিকেরা বলেন, পশ্চিম কথাটি বাদ দেওয়া হলে দেশভাগের ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে।

ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বেনারকে বলেন, “দেশভাগের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হিসেবে এই নাম পরিবর্তন করার চেষ্টা হচ্ছে।”

তিনি মনে করেন, “কেন্দ্রীয় সরকার এই নাম পরিবর্তনে অনুমতি দেবে না।”

প্রবীণ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য্য অবশ্য রাজ্যের নাম পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বেনারকে বলেন, “একসময় এই অঞ্চল বাংলা নামেই পরিচিত ছিল। রবীন্দ্রনাথও তার লেখায় বাংলা নাম ব্যবহার করেছেন। বহু আগে থেকে এই বাংলা নাম চলে আসায় রাজ্যের নাম বাংলা রাখায় কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।”

বাংলাদেশের তরুণ সাহিত্যিক খালিদ মারুফের মতে, এটা সোভিনিজমের প্রকাশ।

তিনি বেনারকে বলেন, “প্রতিবেশী দেশের নাম থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলা রাখাটা এখন এক পক্ষ সোভিনিজম বা উগ্র জাতীয়তাবাদ বলতেই পারে। সেটা বলার সুযোগ তৈরি হলো আর কি!”

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।