সাইবার জগতে নারীকে নিরাপদে রাখতে পুলিশের নতুন সেবা

প্রাপ্তি রহমান
2020.11.16
ঢাকা
201116_cyber_harassment_1000.jpg নারীদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে ঢাকায় আন্তর্জাতিক নারী দিবসের র‍্যালি। ৮ মার্চ ২০১৭।
[বেনারনিউজ]

সাইবার অপরাধ দমনের জন্য পুলিশের বিভিন্ন শাখায় বিদ্যমান নির্দিষ্ট বিভাগগুলোতে অনেক নারী অভিযোগ জানাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করায় ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ নামে সোমবার নতুন একটি সেবা চালু করেছ বাংলাদেশ পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের ল’ফুল ইন্টারসেপশন সেলের অধীনে চালু হওয়া এই নতুন সেবা নারীদের অন্তর্জালে নিরাপদে রাখতে সহায়তা করবে।

সেবাটি উদ্বোধনের সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, “ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান (র‌্যাব), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাইবার অপরাধ দমন ইউনিট রয়েছে।”

“কিন্তু দেখা গেছে অনেক নারীই এসব জায়গায় অভিযোগ জানাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। সেজন্য নতুন এই ইউনিট চালু করা হয়েছে,” বলেন পুলিশ প্রধান।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন নারীরা। যাতে অপরাধের শিকার নারী নিঃসংকোচে তাঁর সমস্যার কথা বলতে পারেন। নতুন এ ইউনিটটি অন্য ইউনিটগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রাখবে।

সাইবার অপরাধকে বৈশ্বিক প্রবণতা দাবি করে ড. বেনজীর বলেন, “এই অপরাধের ধরন আন্তঃরাষ্ট্রীয়। অপরাধী অস্ট্রেলিয়ায় বসেও আফ্রিকায় কাউকে হয়রানি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ছেন নারীরা, যাদের বয়স ১৬ থেকে ২৪।”

“বাংলাদেশেও প্রযুক্তি যত সহজলভ্য হচ্ছে, এ জাতীয় অপরাধীদের তৎপরতা তত বাড়ছে,” মন্তব্য করে পুলিশ প্রধান জানান, দেশে বর্তমানে ১১ কোটি মানুষ মোবাইল ফোন এবং সাত কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।

সাম্প্রতিক এক গবেষণার বরাত দিয়ে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএএফ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বেনারকে বলেন, “আক্রান্তদের মধ্যে নারী ভুক্তভোগীর সংখ্যা ২০১৮ সালের চেয়ে ২০১৯ সালে ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর মোট ভুক্তভোগীর ৬৭ দশমিক নয় শতাংশই ছিল নারী।”

“ভুক্তভোগীদের ৮০ দশমিক ছয় শতাংশ আক্রান্ত হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন না। ২৩ শতাংশ বিষয়টি গোপন রাখতে চাওয়ার কারণে চেপে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। এ ছাড়া ২২ দশমিক সাত শতাংশ জানেনই না কীভাবে আইনি সহায়তা নেওয়া যায়,” বলেন তিনি।

যেসব অভিযোগ গুরুত্ব পাবে

অন্তর্জালে কোনো নারীর ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, ‘সোস্যাল মিডিয়ার আইডি হ্যাক’ করা বা ‘হ্যাক’ করার মাধ্যমে প্রতারণা, ছবি বা ভিডিও সম্পাদনা করে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকির অভিযোগ গুরুত্ব পাবে নতুন এই ইউনিটে।

এছাড়া কারো ছবি ব্যবহার করে ভুয়া আইডি তৈরি, বিভিন্ন জায়গায় ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়া, ‘সাইবার বুলিং’ ও হয়রানি, আপত্তিকর ছবি, ভিডিও বা তথ্য ফাঁস করার হুমকি দিয়ে অর্থ দাবি করা, যৌন হয়রানিমূলক বার্তা, মেইল বা লিংক পাঠানো; এসব ক্ষেত্রেও নতুন সেবার আওতায় অভিযোগ আমলে নেবে পুলিশ।

ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো ও ভুক্তভোগীকে সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে আসার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে নতুন ইউনিটে। সম্পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে আক্রান্তের তথ্য গোপন রেখে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সেবা ও আইনি সহায়তা প্রদান করা হবে।

ফেসবুক পেইজ, ইমেল ও হটলাইন নম্বরের মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণ, প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করবে এলআইসির এই ইউনিট। এ ছাড়া সচেতনতামূলক কার্যক্রমও পরিচালনা করবে তারা।

সিসিএএফ সভাপতি বলেন, “সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেক ব্যবহারকারীর সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। তাই সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব।”

পুলিশ প্রধানের দৃষ্টিতে সাদাত

বাংলাদেশের কিশোর সাদাত রহমান ‘সাইবার টিনস’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সাইবার বুলিং থেকে রক্ষায় ভূমিকা রাখার কারণে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পাওয়ার দুইদিন পরই নতুন সেবাটি চালু করল বাংলাদেশ পুলিশ।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইজিপি বলেন, “নড়াইলের সাদাতের কথা আপনারা জেনেছেন। সাইবার টিনস নামে একটি টিম গঠন করেছিল সে। যখনই কেউ সাইবার স্পেসে হয়রানির শিকার হয়েছে, সাদাত পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।"

সাদাত দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “পুলিশ গণমানুষের সঙ্গে কাজ করতে চায়। যে কেউ পুলিশকে সহযোগিতা করতে পারেন।”

উল্লেখ্য, নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সাদাতকে উল্লেখিত পুরস্কার দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠন কিডস রাইটস। পুরস্কার নিয়ে সোমবার তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে দেশে ফিরেছেন।

সাইবার টিনস' এর হেড অব ক্যাম্পেইন শফিকুল ইসলাম বেনারকে জানান, তিন দিন ঢাকায় অবস্থান করে নড়াইলে ফিরবেন সাদাত।

অপরাধের শিকার হচ্ছে শিশুরাও
“শুধু নারী না, শিশুরাও আজকাল সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে,” উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, “সম্প্রতি শিশু পর্নোগ্রাফি চক্রের সদস্যও গ্রেপ্তার হয়েছে।”

সিসিএএফ-এর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সাইবার অপরাধের মধ্যে পর্নোগ্রাফির হার দুই দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশ হয়েছে মাত্র এক বছরে।

গত বছর সাইবার ক্রাইমের শিকার হওয়াদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ। মোবাইলে ও অনলাইনে হুমকি পেয়েছে তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট হ্যাকিং ও তথ্য চুরিরও শিকার হয়েছে।

এ ছাড়া ছবি বিকৃতি, অপপ্রচার ও অনলাইনে পণ্য কিনে প্রতারণার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁদের।

প্রতিবেদনে ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।