লেদা আশ্রয় কেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের জীবনসংগ্রাম
2017.09.20
কক্সবাজার

আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর, ইস্টার্ন টাইম জোন বিকেল ০৪:০০
গত এক মাস ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার লেদা রোহিঙ্গা শিবিরটিতে বসবাস করছেন ২৮ হাজারের কাছাকাছি শরণার্থী, যাদের অর্ধেকই এসেছেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক সহিংসতায়।
নতুন আসা রোহিঙ্গাদের চাপে পুরোনো আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর অবস্থা দেখতে ১৮ সেপ্টেম্বর লেদা আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন বেনার নিউজের প্রতিবেদক।
টেকনাফ শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তরে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পশ্চিমে লেদা পাহাড়ের ঢালে ২৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই আশ্রয় কেন্দ্র। এখানকার পুরোনো বাসিন্দারা প্রায় সবাই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছেন ২০১২ সালে।
এই আশ্রয় কেন্দ্রটি সরকারি নিবন্ধিত নয়। স্থানীয় পর্যায়ে মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোর জোট এর হিসেবে লেদা আশ্রয় কেন্দ্রে পুরোনো বাসিন্দার সংখ্যা ১৪ হাজার ২৪০ জন। গত ২৫ আগস্ট এর পরে আরো ১৩ হাজার ৬০০ নতুন লোক ঢুকেছেন এই আশ্রয় কেন্দ্রে। তবে নতুনরা যাতায়াতের মধ্যে আছেন। এক দল নতুন খোলা আশ্রয় কেন্দ্রে বা আশপাশের কোনো নতুন বস্তিতে যাচ্ছেন। আবার নতুন একদল এসে ঢুকছেন।
আগস্টের পর থেকে বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী নতুন রোহিঙ্গার সংখ্যা চার লাখ বিশ হাজার বলেও জানা যায় এই জোটের হিসাব থেকে।
নতুন-পুরোনো মিলিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন আট লাখ ছাড়িয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় সাতটি বড় আশ্রয় কেন্দ্রে। টেকনাফের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে লেদা, নতুনপাড়া ও পুটিবুনিয়ায়। আর উখিয়ার আশ্রয় কেন্দ্রগুলো কুতুপালং, থাইংখালি, বালুখালিতে। এ ছাড়া ছোট বড় মাঝারি অনেক রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠেছে এই দুই উপজেলায়।
প্রতি ঘরেই নতুন শরণার্থী
লেদা আশ্রয় কেন্দ্রের সরু গলির দু-পাশে লম্বা করে একেকটি ঘর। বাঁশের বোড়ার ওপরে ত্রিপল বা লবণ খেতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সিটের ছাউনি। এর ভেতরে বেড়া দিয়ে ১৫ হাত লম্বা ১৫ হাত চওড়া একেকটি ঘর বাসিন্দাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
দেশি বিদেশি বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার অর্থায়নে আশ্রয় কেন্দ্রের এই অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রের পরিবেশ অত্যন্ত ঘিঞ্জি হলেও এখানে সুপেয় পানি আর স্যানিটেশনের ব্যবস্থা আছে। এই দুই সুবিধার কারণেই এখানকার বাসিন্দারা সন্তুষ্ট।
আশ্রয় কেন্দ্রে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘরেই নতুন করে আসা কম করে হলেও ১০ থেকে ২০ জন পর্যন্ত মানুষ এসে উঠেছেন। এত লোকের চাপ সামাল দিতে পুরুষ ও শিশু কিশোররা সাধারণত দিনের বেলায় ঘরেই ঢোকে না। রাতে সবাই মিলে মেঝেতে মাদুর পেতে কোনোমতে গাদাগাদি করে ঘুমিয়ে থাকেন।
মাইমুনা বেগমের ঘরটি সি-ব্লকে। তার নিজেরই পরিবারের লোকসংখ্যা ১৩ জন। তার ওপরে নতুন এসে উঠেছেন ১৬ জন। বেনারকে তিনি বলেন খুব কষ্ট করে আছেন। কিন্তু এক সময় তাঁরাও বাংলাদেশে এসে এভাবেই পরিচিতদের ঠিকানায় উঠেছিলেন। সেসব কথা বিবেচনা করে সমায়িক এই কষ্ট মেনে নিচ্ছেন।
সকলেই কাজ করেন
লেদা আশ্রয় কেন্দ্রে কোনো খয়রাতি সাহায্য আসে না। পুরুষেরা সবাই নানা ধরনের কাজ করেন। একটি বড় অংশ স্থল বন্দরে দিনমজুরি করেন। সাব্বির মাঝি (শ্রমিক সর্দার), আইতাজ মাঝি, দেলোয়ার মাঝি, জোবায়ের মাঝিসহ বেশ কয়েক জন মাঝির অধীনে প্রায় চার শ জন রোহিঙ্গা স্থল বন্দরের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
প্রায় পাঁচ বছর ধরে স্থল বন্দরে শ্রমিকের কাজ করছেন লেদা আশ্রয় কেন্দ্রের ইয়াজ উদ্দিন। বেনারকে তিনি জানালেন, বন্দরে আমদানির ওপরে নির্ভর করে প্রতিদিন তাদের অন্তত দুইশো টাকা থেকে পাঁচ-ছয়শো টাকা পর্যন্ত আয় হয়।
হাবিবুল্লাহ সাগরে মাছ ধরেন। এখন তাঁর বয়স ২৬ বছর, এখানে যখন আসেন তখন বয়স ছিল ১১ বছর। বাবা নেই। মংডুতে সেনাবাহিনী তার বাবাকে খুন করেছিল। ক্যাম্পের বি-ব্লকের ৬৫ নম্বর ঘরটি তার। বিয়ে করেছেন, দুটি ছেলে। তাঁর শাশুড়ি আর স্ত্রী দুজনেই টেকনাফ শহরে হোটেলে রান্নার কাজ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরোনো রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই দিন মজুরের কাজ করেন। কেউ অটো রিকশা চালান, রাজমিস্ত্রির জোগালি দেন, অল্পবয়সীরা বাসের চালকের সহকারীর কাজ করেন। ইটের ভাটায় কাজ করেন কিছু লোক।
পুরোনো রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ, বাংলাদেশের জেলে নৌকাগুলোতে চুক্তি ভিত্তিতে (মাছ বিক্রির টাকার অনুপাতে) কাজ করেন। শুঁটকি, শাকসবজি, চা-পানের দোকান বা ছোট খাট ব্যবসাও করেন কেউ কেউ। বিশেষ করে কৃষি শ্রমিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের বেশ কদর রয়েছে।
অনিবন্ধিত আশ্রয় কেন্দ্রে যেহেতু কোনো খয়রাতি সাহায্য দেওয়া হয় না তাই আশ্রিতারা কেউ বেকার নেই। কিছু না কিছু কাজে লেগে পড়েছেন পুরুষেরা। তবে রোহিঙ্গা নারীরা এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে। খুব অল্প সংখ্যক নারীই উপার্জনের প্রক্রিয়ায় আছেন। অনেকেই বোরকা পরে বাচ্চা কোলে ভিক্ষা করতে বের হন। তা ছাড়া প্রায় সবাই ঘরেই সংসারের কাজ করেন।
শিক্ষার সুযোগ কম
সরকারি নিবন্ধিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর প্রতিটি ব্লকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার একাধিক স্কুল থাকলেও অনিবন্ধিত ক্যাম্পগুলোতে শিক্ষার সুযোগ তেমন নেই।
লেদা ক্যাম্পে একটি আরবি শেখার স্কুল আছে। সেখানে শিশুদের আরবি শেখান তৈয়ব আলী। বেনারেক তিনি জানালেন মংডুর গজার বিল এলাকা থেকে এখানে এসেছিলেন কিশোর বয়সে। এখানেই পড়া লেখা শিখে এখন শিক্ষকতা করছেন।
রোহিঙ্গাদের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস
মিয়ানমারের রাশি ডং এলাকা থেকে দেড় বছরের এক নাতনিকে নিয়ে সম্প্রতি লেদা কেন্দ্রের সি ব্লকের সাব্বির মাঝির ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন ৪৫ বছরের জামিলা খাতুন। জামিলা বেনারকে জানালেন, তাঁর স্বামী রোগে ভুগে মারা গেছেন। ভালো চিকিৎসা হয়নি। আরাকানে রোহিঙ্গাদের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থাও নেই।
ছেলে বশীর উল্লাহ ও তার স্ত্রী শরিফা আর এই দেড় বছরের নাতনি রোকেয়াকে নিয়েই তাদের সংসার ছিল। ঈদের দুই দিন আগে মিয়ানমারের সৈনিকেরা তাদের গ্রামে হামলা করে। তারা বশীর উল্লাকে গুলি করে হত্যা করে। শরিফাকে গণধর্ষণের পর বড় ছুরি দিয়ে কেটে কেটে হত্যা করে।
লেদা আশ্রয় কেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের সামাজিক সর্দার (কমিউনিটি লিডার) হিসেবে কাজ করছেন সি-ব্লকের ১৯ নম্বর ঘরের বাসিন্দা আবদুল মোত্তালেব। তাঁর বাড়ি ছিল মংডুর উদং গ্রামে। তিনি ওই গ্রামে ১৯৬৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচিত গ্রাম প্রধান ছিলেন। বয়স ৬৭ বছর চলছে। বাংলাদেশে এসেছেন ২০০৩ সালে।
বেনারকে মোত্তালেব জানালেন, “খুবই পরিকল্পিতভাবে মিয়ানমার সরকার সেনাবাহিনী ও রাখাইনদের দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উৎখাত করছে। রোহিঙ্গাদের একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আরাকানি রোহিঙ্গারা নাগরিক ছিলেন। সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। পরে সামরিক শাসন জারি করে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। আরাকানের নাম বদলে রাখাইন করা হয়।”
“নানা অজুহাতে রোহিঙ্গাদের ওপরে জুলুম নির্যাতন চালানো শুরু হয়। তাদের জমি দখল করে বৌদ্ধদের এনে বসতি করা হয়। তারপর বিভিন্ন সময় দফায় দফায় হত্যা, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া এসব ঘটনা ঘটে চলেছে। রোহিঙ্গাদের চলাচলের ওপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা নিজ জেলা ছাড়া অন্য কোথাও যেতে পারেন না,” জানালেন মোত্তালেব।
ওই নেতা জানান, সেখানে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। সরকারি চাকরি নেই। মিয়ানমারে অত্যন্ত জুলুম নির্যাতনের ভেতরে অমানবিক জীবন যাপন করছেন এই জনগোষ্ঠী।