সংবাদকর্মীর দেখা রোহিঙ্গা দুর্ভোগ
2017.09.22
কক্সবাজার

সাধারণত সমুদ্র সৈকতের পাশ দিয়ে তৈরি নতুন মেরিন ড্রাইভ ধরে কক্সবাজার থেকে টেকনাফে যেতে নিজস্ব গাড়িতে এক ঘণ্টার কিছু বেশি সময় লাগে; বাসে ঘণ্টা দুই এর পথ। সেই পথ পার হতে এখন চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত লাগছে। কারণ পথে পথে রোহিঙ্গাদের স্রোত।
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের দুই পাশ দিয়ে সম্প্রতি আসা সর্বস্ব হারানো রোহিঙ্গাদের সারি। বাবা-মাকে অনুসরণ করছে ছোট ছেলে-মেয়েরা। কেউ চলতে চলতে পাথের পাশেই বসে পড়েছেন পোঁটলা বেঁধে সঙ্গে আনা শেষ সম্বল টুকু নিয়ে। কেউ কেউ আবার সড়কের একটু অদূরেই খোলা জায়গায় বাঁশ-প্লাস্টিক সিট দিয়ে ঘর তৈরি করছেন।
রোহিঙ্গা দুর্গতদের জন্য অনেকেই ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা নানা রকমের যানবাহনে করে শুকনো খাবার, পুরোনো পোশাক-আশাক ইত্যাদি পথের পাশের রোহিঙ্গাদের বিতরণ করছেন।
ত্রাণের আশায় শত শত রোহিঙ্গা এসব গাড়ির পাশে ভিড় করছে। সড়কের ওপর ছোটাছুটি করছে। ত্রাণ বিতরণকারী গাড়িগুলোর পেছনে পেছনে তারা ছুটছে দলে দলে। এতে সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের গতি মন্থর হয়ে পড়ছে।
রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য বেনারনিউজের পক্ষ থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে বিমানে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যাত্রা করি।
এবার মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তাদের মদদপুষ্ট বৌদ্ধ আরাকানি নাগরিকেরা রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরু করেছে গত ২৫ আগস্ট থেকে। তারা প্রতিদিন একের পর এক রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের হত্যাকাণ্ড থেকে শিশু, নারী, বৃদ্ধ কেউ বাদ পড়ছে না।
সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বরাতে সেই বর্বরতার কাহিনি প্রতিদিন তুলে ধরা হচ্ছে। এই মানবতাবিরোধী ঘটনার শিকার মানুষদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতেই টেকনাফে রওনা দিয়েছিলাম।
গত এক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছেন চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। যাদের বেশিরভাগই এসে উঠছেন টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। এর বাইরে আগে থেকেই বাংলাদেশে রয়েছেন আরো প্রায় চার লক্ষ রোহিঙ্গা।
কক্সবাজার থেকে আন্তঃজেলা মহাসড়ক দিয়ে টেকনাফের দিকে রওনা হয়ে যখন উখিয়া আসলাম তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল।
এই বৃষ্টির মধ্যেই সড়কের দুই পাশ দিয়ে নিজ দেশ থেকে উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্রোতোধারা দেখা গেল টেকনাফ শহর পর্যন্ত। প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছেন বিপন্ন মানুষ। এই জনস্রোতের বাধা ঠেলে টেকনাফ পৌঁছতে সমল লেগে গেল চার ঘণ্টার ওপরে।
মাঝিদের রমরমা
টেকনাফ শহরকে মনে হলো রোহিঙ্গাদের ট্রানজিট পয়েন্ট। প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে বিজিবি বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। তারা নাফ নদী পার হওয়ার সময় রোহিঙ্গাদের অনেক নৌকা ফিরিয়ে দেয়। স্থানীয় জেলেদের মধ্যে অনেকে গোপনে গভীর রাতে নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের পার করতে থাকে। এতে নৌকাডুবির ঘটনা এবং প্রাণহানিও ঘটতে থাকে।
এই অবৈধ পারাপার বন্ধ করতে স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিবির তরফ থেকে সমায়িকভাবে সমুদ্রে মাছধরার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। নাফ নদী টেকনাফ শহরের উত্তর দিকে বেশ ক্ষীণ। হোয়াইক্যাং ইউনিয়নের লম্বা বিল এলাকায় মাত্র ২০ থেকে ৩০ মিনিটেই নদী পর হওয়া যায়। নদীটি দক্ষিণে ক্রমশ চওড়া হয়ে শাহপরীর দ্বীপের কাছে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। আরও দক্ষিণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। এদিকে নদী পার হতে দুই ঘণ্টা থেকে ক্ষেত্র বিশেষে চার পাঁচ ঘণ্টাও লেগে যায়।
সম্প্রতি মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সরকার নমনীয় ভূমিকা নেয়, এতে মিয়ানমারের সঙ্গে এই জল সীমান্তে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়। এই সুযোগে প্রায় সাত-আটশো নৌকায় রাতদিন সমানে রোহিঙ্গাদের পারাপার শুরু হয়।
প্রথম দিকে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন তাদের কাছ থেকে সুযোগ বুঝে জনপ্রতি পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার বাংলাদেশি টাকার সমপরিমাণ মিয়ানমারের কিয়েট (সে দেশের টাকা) ভাড়া নেওয়া হয়েছে। পরে এই ভাড়া দুই থেকে তিন হাজার বা আরও কমে নেমে আসে।
বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ঘুমধুম ও সাপমারা স্থল সীমান্ত দিয়েও কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল। তবে এখানে মিয়ানমার সীমান্তে সেদেশের সেনাবাহিনী স্থল মাইন পুঁতে রেখেছে। দুটি স্থল মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় আমরা চারজন রোহিঙ্গার প্রাণহানির সংবাদ পাই। তারপর থেকে স্থল সীমান্ত পথে রোহিঙ্গাদের পারাপার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। জল সীমান্তকেই তারা ব্যবহার করতে থাকে।
নৌকায় করে রোহিঙ্গাদের সীমান্ত পেরিয়ে আসা দেখতে আমি ১৬ সেপ্টেম্বর শাহপরীর দ্বীপে যাই। দেখলাম দ্বীপের বাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণে কোমর সমান পানিতে প্রায় আধা ঘণ্টা বা তার কিছু কমবেশি সময় পরপর রোহিঙ্গাদের নিয়ে জেলে নৌকাগুলো এসে ভিড়ছে।
বড় নৌকাগুলোতে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জন এবং ছোট নৌকা ১৫ থেকে ২০ জন পর্যন্ত লোক ও তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র আনা হয়েছে। কেউ কেউ একটি দুটি করে ছাগল বা মুরগিও নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে।
নৌকা থেকে নেমে তারা এসে প্রথম দফায় সমবেত হচ্ছেন বাজারের পাশের মাঠের মতো খোলা জায়গায়। সেখান থেকে বিজিবির তত্ত্বাবধানে ট্রাকে করে বিনা খরচায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে টেকনাফের পুটিবুনিয়া বা উখিয়ার থাইংখালির নতুন ক্যাম্পে। তবে যারা ইচ্ছুক শুধু তাদেরই নেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে অনেকে আরও প্রায় এক-দেড় কিলোমিটার উত্তরে সাবরাং এসে সাইক্লোন শেল্টারে উঠছেন। এখানে সব সময় শত শত রোহিঙ্গা অবস্থান করেন। চেনা জানারা এলে তাদের সঙ্গে মিলিত হন। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে একটু খাওয়া দাওয়া করে টেকনাফের দিকে রওনা দেন।
শরণার্থী জনপদ
টেকনাফ শহর রোহিঙ্গায় ভরা। কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের সামনে থেকে ট্রাকে করে রোহিঙ্গাদের নতুন ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। সারা শহরে রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের অনেকে ক্যাম্পে যাচ্ছে। অনেকে এসে উঠছে এখানে আগে থেকে বাড়ি ভাড়া করে থাকা আত্মীয় বা পরিচিতদের বাসায়। অবস্থাসম্পন্ন অনেকে নিজেরাই বাড়ি ভাড়া নিচ্ছে। অনেকে পোশাক-আশাক পালটে নিয়ে দূরপাল্লার বাসে করে চট্টগ্রাম বা দেশের অন্য এলাকাতেও যাওয়ার চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত টেকনাফ শহর হাজার হাজার রোহিঙ্গার সমাগমে সরগরম হয়ে থাকে।
টেকনাফ শহর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার উত্তরে পুরোনো দুটি ক্যাম্প। অনিবন্ধিত লেদা ক্যাম্প এবং নিবন্ধিত নয়াপাড়া ক্যাম্প। এ ছাড়া প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে হোয়াইক্যাং ইউনিয়নের পুটিবুনিয়ায় করা হয়েছে নতুন ক্যাম্প। এই তিন ক্যাম্পে নতুন পুরোনো আশ্রিতের সংখ্যা দুই লক্ষাধিক।
উখিয়ার থাইংখালিতেও করা হয়েছে নতুন ক্যাম্প। পুরোনো তিন ক্যাম্প বালুখালি, কুতুপালং টিভি উপকেন্দ্র সংলগ্ন পাহাড় ও কুতুপালং পাহাড়ে। কুতুপালং পাহাড়ের ক্যাম্পটি নিবন্ধিত। এখানে নতুন-পুরোনো রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। সবগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্পই করা হয়েছে পাহাড় ও সংরক্ষিত বন কেটে।
এ ছাড়া টেকনাফের নেচার পার্ক, বাহার ছড়া, মেরিন ড্রাইভ এবং উখিয়ার বিভিন্ন রাবার বাগান, বাগ গোনা, জামতলি এসব এলাকায় পতিত জায়গা, খালের পাড়ে সড়কের ধারা ছোট-বড় অনেক ঝুপড়ি ঘর করে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা বস্তি।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতেও প্রায় হাজার পঞ্চাশেক রোহিঙ্গাকে পাহাড়ে বস্তি তুলে বসবাস করতে দেখলাম। এতেও রোহিঙ্গাদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। কুতুপালং ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব রেজাউল করিম জানালেন, সরকারের কাছে আরও দুই হাজার একর জায়গা বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। উপযুক্ত জায়গা খোঁজা হচ্ছে।
দুর্ভোগের উদ্বাস্তু জীবন
টেকনাফ ও উখিয়ার সবগুলো নতুন পুরোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পই আমি ঘুরে দেখেছি। এখানে প্রায় প্রতিদিনই দিনের কোনো না কোনো সময় বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে ভিজে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ বাড়ে। আশ্রয় ক্যাম্পগুলোতে সরকারি উদ্যোগে ৩৬টি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনেক মেডিকেল ক্যাম্প করা হয়েছে। চিকিৎসকেরা পুটিবুনিয়া ক্যাম্পে আল-কামার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চিকিৎসক ইউসুফ হোসেন আমাকে জানান, রোহিঙ্গা শিশুদের প্রায় ৮৫ ভাগই সর্দি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া শত শত নারী ও বয়স্ক পুরুষরাও এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে দেখলাম পুরোনো ক্যাম্পে সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে নতুন আসা লোকের চাপে নাজুক হয়ে পড়েছে। আর নতুন ক্যাম্পগুলোতে পানি ও স্যানিটেশনের সুবিধাই নেই।
সুপেয় পানির অভাবে রোগব্যাধি আক্রান্তের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। প্রথম দিকে ত্রাণ বিতরণেরও কোনো সমন্বয় ছিল না। ১৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শৃঙ্খলা তৈরি করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
নির্যাতনের স্মৃতি
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি চরম নির্যাতনের কাহিনি। নয়াপাড়া ক্যাম্পে হাফেজ সোলায়মান উদ্দিন মংডুর একটি মাদ্রাসায় আরবি পড়াতেন। স্ত্রী তিন ছেলেময়ে আত্মীয়-স্বজন মিলিয়ে ১১ জনের দল নিয়ে এখানে এসেছেন।
তিনি বললেন, মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনী অনেক দিন থেকে খুবই পরিকল্পনা মাফিক রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপরে নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তারা রোহিঙ্গাদের জমিজমা দখল করে সেখানে মগদের এনে বসতি করছে। সেই মগদের করেছে গ্রাম প্রধান। এই মগেরা নানাভাবে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে। জমির ফসল কেটে নিয়ে যায়, মারধর করে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এর কোনো বিচার চাইতে পারেন না। থানায় রোহিঙ্গাদের অভিযোগ নেওয়া হয় না। আর অভিযোগ করতে গেলে নির্যাতন আরও বাড়ে।
এবারের হামলায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে এই মগেরাও ছিল সক্রিয় ভূমিকায়। বাড়িতে আগুন দেওয়া, লুট করা, এমনকি খুন, ধর্ষণের কাজেও তারা অংশ নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিরুপায় হয়েই রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
এখনো এই পালিয়ে আসা জনস্রোত থামেনি।