জঙ্গিবাদ ঠেকাতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবে
2016.07.12

জঙ্গিবাদ দমনের লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এবার সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার ঘটনায় একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সাবেক বা বর্তমান শিক্ষার্থীদের নাম আসতে থাকায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আগামী ১৭ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও মালিকদের সঙ্গে প্রথম বৈঠক হবে। আর ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠক।
অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে অংশ নেওয়ার প্রচলিত ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। এখন জঙ্গি তৎপরতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জঙ্গি হওয়ার শিক্ষা দেয় না। জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার পেছনে রয়েছে দেশি ও বিদেশি রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় বেশি প্রভাবিত করে শিক্ষার্থীদের।
গত ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের জিম্মি ঘটনায় নিহত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে একজন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী, একজন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, একজন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও একজন বগুড়ার একটি মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষার্থী।
গত ৭ জুলাই শোলাকিয়ায় ঈদগাহের পাশে পুলিশের ওপর হামলা করে জঙ্গিরা। সেখানে পুলিশের গুলিতে হামলাকারী জঙ্গি আবির রহমান নিহত হয়। সেও নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার বাংলাদেশি তরুণ কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসও দেশে থাকাকালে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো। ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী।
নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি সূত্রে জানা যায়, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে পাঁচজন শিক্ষক ও ১৪ জন শিক্ষার্থী।
গুলশানের হোলি আর্টিজানের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া আবুল হাসনাত রেজা করিমও নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির বিজনেস ফ্যাকাল্টির সাবেক শিক্ষক। সে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহের তালিকায় রয়েছে।
গুলশান হামলার পর এর প্রশংসা করে এক ভিডিওবার্তায় আরও হামলার হুমকি দেয় বাংলাদেশের তিন তরুণ। এদের একজন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। অন্যজন একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষার্থী।
গুলশানের জঙ্গি হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিখোঁজ যে ১০ যুবকের তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ বাসারুজ্জামান লেখাপড়া করেছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ।
“সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এসেছে। কিন্তু উগ্রবাদের একমাত্র উপাদান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়,” বেনারকে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৯ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় কাটায়। তার বাইরে যে সময়টা আছে, তা সে বিভিন্ন জায়গায় পার করে।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কড়া সমালোচনা করেন। সেখানে লেখাপড়ার বদলে জঙ্গি তৈরী করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তাঁরা।
কড়া সমালোচনার মুখে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে যে, কোনো শিক্ষার্থী এক সেমিস্টার অনুপস্থিত থাকলে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হবে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেওয়া সিদ্ধান্ত যথার্থ নয়। তিনি বলেন, এক সেমিস্টার নয়; বরং ১০ দিন অনুপস্থিত থাকলেই এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে নর্থ সাউথ নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মানারত বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্কলাষ্টিকা স্কুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘিরে জঙ্গি তৎপরতা চলার অভিযোগ রয়েছে।
“আমরা বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদের বিকাশ ঘটলে এর দায়দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও। এখানে সরকার বা পরিবারকেই শুধু দেখিয়ে দিলে হবে না,” বেনারকে জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২৩ জুলাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে বৈঠকটি হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। তার আগে ১৭ জুলাই রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক হবে।
ওই দুটি বৈঠকের মাধ্যমে সরকারের মনোভাব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হবে, যাতে তাঁরা সতর্ক হয় এবং শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়।
“আগে জঙ্গিবাদের সঙ্গে নিম্নবিত্ত পরিবারের বা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নাম আসত। এখন উচ্চবিত্ত পরিবারের মেধাবী ছেলেদের নাম আসছে। এটা খুবই উদ্বেগজনক,” বেনারকে জানান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মো. কায়কোবাদ।
তাঁর মতে, দেশি–বিদেশি চক্র আমাদের মেধাবী ছেলেদের ভুলপথে পরিচালিত করছে। যত দ্রুত ও যেভাবে সম্ভব, এটা বন্ধ করতেই হবে,”
জুমার খুতবায় নজরদারি নিয়ে প্রশ্ন
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে জুম্মার নামাজের খুতবায় নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত রোববার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
সমালোচনার জবাবে নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল মঙ্গলবার জানান, খুতবার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে না।
বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় বয়ানে জঙ্গিবাদে প্ররোচনা জোগানো হয় বলে অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষাপটে নানা পদক্ষেপের সঙ্গে জুম্মার খুতবায়ও নজর রাখার কথা বলা হয়েছিল।
এই পদক্ষেপে কারও কারও সমালোচনার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে শাজাহান খান বলেন, “একটি মহল মসজিদে খুতবার ওপর নজরদারি নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে।”
“আসলে সব মাওলানা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নয় । তাই খুতবা পড়ার সময় জঙ্গিবাদ নিয়ে কোনো ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে কি না, তার ওপর নজরদারি রাখা হবে,” বলেন শাজাহান খান।