এবার মিডিয়া এবং নারী সাংবাদিকদের হুমকি দিলো আনসারউল্লাহ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.10.19
BD-abt গত ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে সন্দেহভাজন কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বেনার নিউজ

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের নামে ইমেইল পাঠিয়ে সোমবার বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে ‘জেহাদ বিরোধী’ সংবাদ প্রকাশ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের নামে বিশিষ্ট নাগরিকদের হুমকি সংবলিত বার্তা এর আগেও গণমাধ্যমে এসেছে।

গত এক বছরেরও কম সময়ে চারজন ব্লগার খুনের সঙ্গে আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। সম্প্রতি দুই বিদেশি খুন হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের দায় স্বীকারের খবর এবং বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা শুরু হয়।

তবে ওই দুই খুনে আইএসের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি জানিয়ে সরকার বলেছে, বাংলাদেশে আইএস বা এ ধরনের কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতা নেই। তবে দেশে জেএমবি, আনসারউল্লাহ, হরকাতুল জিহাদসহ বিভিন্ন নামের জঙ্গিগোষ্ঠী থাকার কথা স্বীকার করছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সর্বশেষ গত শনিবার গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারকে হুমকি দিয়েছে আরাফ আল ইসলাম আইএসবি নামে একটি সংগঠন । এর আগে আনসারউল্লাহও তাঁকে হুমকি দেয়।


নারী সাংবাদিকদের প্রতিক্রিয়া

গতকাল সোমবার জঙ্গি ওই সংগঠনটির ছয় দফা ‘নির্দেশনা’ বিভিন্ন গণমাধ্যমে পৌঁছে। এতে বলা হয়েছে, “আমাদের নির্দেশনা আজ থেকে আপনাদের জন্য আইন। ইসলামের পথে না চললে আপনাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ। উঁচু উঁচু ভবন সব ধুলায় লুটাবে, আপনাদের শির লুটাবে ইসলামের সেনানীদের পদতলে।”

নারীদের ঘরের বাইরে চাকরি করা ইসলামি শরিয়া মতে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ বলে দাবি করা হয়েছে ওই বার্তায়। বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের নারী কর্মীদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে হবে।

“বাংলাদেশে গণমাধ্যমে নারী কর্মী বাড়ানোর চেষ্টা যখন চলছে এবং ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যখন নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে, তখন জঙ্গিদের এই হুমকি নিন্দনীয়,” জানান নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আর হক মিনু।

তাঁর মতে, এর আগে হেফাজতে ইসলাম নারীদের লেখাপড়া ও কাজ করা নিয়ে ফতোয়া দিয়েছিল। সব সময় সব মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠীর লক্ষ্য নারীরা।

“নারীর মেধা ও শ্রম মিলিয়ে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এ ধরনের হুমকি, অপপ্রচার ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে,” জানান নাসিমুন আরা।

“আমরা এসব হুমকির তোয়াক্কা করি না। গণমাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, আরও বাড়বে। জঙ্গিদের রক্তচক্ষু নারীদের ঘরে ফিরিয়ে নেবে না,” বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী সাংবাদিক ।

তাঁর বক্তব্য— জঙ্গিদের কথা মেনে চললে নারীকে ঘরে বসে শুধু সন্তান জন্ম দিতে হবে।


তদন্ত করে দেখছে পুলিশ

গতকাল সোমবার দুপুরের পর ansarullahbanglabd@gmail.com থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই ইমেইল পাঠানো হয়। এর আগে ডাকযোগে এসব হুমকি পাওয়া গেলেও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ই মেইল ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা।

বার্তার ওপরে ঠিকানা লেখা হয়েছে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম, প্রধান কার্যালয়, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ। শেষে প্রেরকের জায়গায় লেখা হয়েছে আবদুল্লাহ বিন সালিম , প্রচার সমন্বয়ক, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামবিরোধী প্রচারণার অভিযোগ তুলে কয়েকজন ব্লগারের নাম উল্লেখ করে তাদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।

“বিভিন্ন পত্রিকায় আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের মেইলের খবরটি আমরা জানতে পেরেছি।এর একটি কপিও সংগ্রহ করা হয়েছে।এ ছাড়া বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মুনতাসিরুল ইসলাম।

তিনি জানান, এই চিঠি কোথা থেকে এসেছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

এদিকে গণমাধ্যমকে হুমকি দিয়ে আনসারউল্লাহর চিঠিতে বলা হয়, “আপনারাও যদি নাস্তিক্যবাদীর সহায়তাকারী হন তবে কাউকে ছাড়া হবে না। আপনাদের বাক স্বাধীনতা যদি আমাদের বেঁধে দেওয়া সীমা না মানে তবে আমাদের ক্রোধ প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রত্যেক সংবাদমাধ্যম যেন প্রস্তুত থাকে।”

নারীদের চাকরিচ্যুত করার দাবির পক্ষে যুক্তি দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, “যেহেতু নারীদের ঘরের বাইরে চাকরি করা, বেপর্দা হয়ে ঘোরাঘুরি করা ইসলামি শরিয়া মতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তাই যারা এদের চাকরি দিচ্ছেন, করাচ্ছেন, তারাও সমানভাবে দোষী।”

চিঠিতে সকল সংবাদমাধ্যমের প্রতি নারীদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আহ্বান জানায় ওই জঙ্গিগোষ্ঠী।


অন্য যেসব দাবি!

# ইসলামবিরোধী, নাস্তিক্যবাদী শক্তির কোনো প্রকার প্রচারণায় শামিল হওয়া যাবে না।

# ইসলামের সেনানীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার অপপ্রচার চালানো যাবে না। তাদের যেকোনো জেহাদি কর্মকাণ্ডের সমালোচনা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।

# পত্রিকার বিজ্ঞাপনে নারী মডেলের ছবি ব্যবহার করা যাবে না। কোনো নারীর বেপর্দা ছবি পত্রিকায় ছাপানো যাবে না।

# বিনোদন পাতা, নৃত্য, গীত, নাটক, সিনেমা এমন যেকোনো ইসলামি শরীয়তবিরোধী যা সমাজে ‘ফিতনা’ ছড়ায়, যুবক-যুবতীদের মনে যৌনতা উসকে দেয় তা প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে।

# যেকোনো নাস্তিকের মৃত্যুর পরে পত্রিকায় কোনো প্রকারের জেহাদ বিরোধী সংবাদ করা যাবে না। করলে সে পত্রিকায় চাকরিরত এবং মালিক পক্ষকে নাস্তিক, নাস্তিক্যবাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে গণ্য করে সমূলে উপড়ে ফেলা হবে।

বিদেশে অবস্থানরত নয়জন এবং দেশে বসবাসরত ছয়জন ব্লগারের নাম তুলে দিয়ে চিঠিতে বলা হয়েছে, “যারা বিদেশে আছেন তাদের দেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আর যারা দেশের অভ্যন্তরে গা ঢাকা দিয়ে আছেন তাদের সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হবে।”

চিঠির শেষ অংশে বলা হয়, “আমাদের লক্ষ সেনানী প্রস্তুত হচ্ছে ইসলামের পবিত্র এই ভূমির আনাচে কানাচে। আমাদের প্রস্তুতি শেষের প্রায় চূড়ান্ত। যেকোনো দিন খেলাফত কায়েমের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ব আমরা।”

চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশ কিংবা বিদেশে পালিয়ে থাকা নাস্তিকদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কেউ যেন নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে না পড়েন।তাহলে পরিণতি হবে নিলয় নীল কিংবা ওয়াশিকুর বাবু, অভিজিৎ রায়ের মত।


ইমরান এইচ সরকারকে হুমকি

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারকে হুমকি দিয়েছে আরাফ আল ইসলাম আইএসবি নামে একটি সংগঠন । শনিবার সকালে সংগঠনটির একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এই হুমকি দেওয়া হয়। এ জন্য জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তিনি।

“ইমরান এইচ সরকারের সাধারণ ডায়েরিটি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। তাঁকে সতর্কভাবে চলাফেরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানান শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক।

ইমরান এইচ সরকার বলেন, “ওইদিন সকাল ১০টা ১৯ মিনিটে আমার ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টে তিনবার একই মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দেয়। ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আমি সেটা দেখি। সেখানে বলা হয়, বিদেশিদের মতো আমাকেও হত্যা করা হবে।”


“কাপুরুষদের এ ধরনের হুমকিকে হয়তো এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। তবে এদেরকে আইনের আওতায় আনাটা আমি এই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। কেননা এই সন্ত্রাসীরা হুমকিই দিচ্ছে না, কাপুরুষোচিত হামলা করে একের পর এক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়েই যাচ্ছে,” বেনারকে জানান ইমরান এইচ সরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।