বাউল আখড়ায় হামলা,নারীসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.07.18
20160718-Baul-BD1000.jpg চুয়াডাঙ্গায় একটি বাউল আখড়ায় হামলা চালিয়ে নারীসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম করার পর আহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। জুলাই ১৬, ২০১৬।
বেনার নিউজ

গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর দেশজুড়ে আতংকের মধ্যে গত শনিবার দক্ষিণাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গায় বাউল আখড়ায় হামলা চালিয়ে নারীসহ তিনজনকে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা।

এর একদিন পর সোমবার দেশের তিন জেলায় হত্যার হুমকি পেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন চারজন পুরোহিত। হুমকির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার কথা বলছে পুলিশ।

তবে বাউল আখড়ায় হামলার ঘটনাকে ব্যক্তিগত আক্রোশের জের হিসেবে দেখছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। যদিও স্থানীয় বাসিন্দারা পুলিশের এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন।

সম্প্রতি ঝিনাইদহে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান এবং কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় কিছু হামলার ধরন দেখে বাউল আখড়ায় হামলার পেছনে জঙ্গিরা দায়ী বলে স্থানীয়দের সন্দেহ।

উল্লেখ্য, গত শনিবার চুয়াডাঙ্গার বাউল আখড়ায় একটি অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধু ও লালন ভক্তরা যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে ওই চারজন রাতে আখড়ায় থেকে যান।

স্থানীয়রা জানান, গভীর রাতে তাঁদের ওপর হামলা চালায় একদল মুখোশধারী দুর্বৃত্ত। এসময় আখড়া ভাঙচুরের পাশাপাশি নারীসহ তিনজন বাউলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়।

আহতরা হলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার শরুদা গ্রামের বুলু বেগম (৫০) ও তাঁর স্বামী আব্দুর রহিম (৬৫) এবং ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের ফজলুর রহমানের স্ত্রী রুশিয়া বেগম (৬০)।

এদের মধ্যে রুশিয়া বেগম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও বুলু বেগম কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। অন্যজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে রোববার হাসপাতাল ছেড়েছেন।

আখড়ার তদারককারী মুকুল হোসেন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, “মধ্যরাতের পর ১০-১২ জন দুর্বৃত্ত আখড়ায় ঢুকে ওই চারজনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। তাঁদের চিৎকার শুনে গ্রামবাসী এগিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়,” জানান মুকুল।

রুশিয়া বেগমের চাচা আলিম উদ্দিন বেনারকে বলেন, কাউকে চিনতে পারেনি আক্রান্তরা। রুশিয়ার সঙ্গে কারও কোনো বিরোধ ছিল না।

তিনি আরও জানান, “রুশিয়া চোখের নিচে কোপ দেওয়া হয়েছে। সে পায়ে আঘাত পেয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার তাঁর অপারেশন হবে।”

আরেক আহত বুলু বেগমকে অর্থাভাবে ঢাকায় আনা সম্ভব হয়নি বলে বেনারকে জানান স্থানীয় সাংবাদিক জিসান আহমেদ।

এ ঘটনায় রোববার রাতে অজ্ঞাত ৭-৮ জনকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন অপর এক বাউল শহিদুল ইসলাম। সোমবার ভোরে উপজেলার সেনেরহুদা গ্রামে অভিযান চালিয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে তিনজনকে আটক করেছে স্থানীয় পুলিশ। এরা হচ্ছে—আরিফুল (২২), শাহেদ (৩০) ও জামাত আলী (৪০)।

জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হ‌ুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা এ ঘটনাকে জঙ্গি-হামলা বলে সন্দেহ করলেও পুলিশের মতে, ব্যক্তিগত আক্রোশের জের ধরে এ হামলা হয়েছে। তবে পুলিশ এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ অবশ্য দিতে পারেনি।

এ বিষয়ে ওসি হ‌ুমায়ূন কবির বেনারকে বলেন, “আটকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, কোনোভাবেই এটা জঙ্গি হামলা নয়। তবে কেন হামলা চালানো হয়েছে, কী ধরনের ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

এর আগে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার এক গ্রামে বাউল উৎসবের আয়োজক জাকারিয়া সরদারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এ বছর ২০ মে কুষ্টিয়া সদরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় বাউল ভক্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক মীর সানোয়ার রহমানকে। ওই হামলায় গুরুতর আহত হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামান।

এবারের হামলাও ওই সব ঘটনার ধারাবাহিকতা বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা।

এ বিষয়ে সাংবাদিক জিসান আহমেদ বেনারকে বলেন, “গুলশানে হামলাকারীদের আস্তানা ছিল জীবননগরের নিকটবর্তী ঝিনাইদহ জেলায়। এর আগে জীবননগরে একই কায়দায় বাউল ভক্তের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। সেসব লক্ষণ দেখে অনুমান করা যায়, এটাও সেসব হামলার ধারাবাহিকতায় হতে পারে।”

নিরাপত্তাহীনতায় চার পুরোহিত

এদিকে হত্যার হুমকির চিঠি পেয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন দেশের তিন জেলার চার পুরোহিত। এরা হলেন, রংপুরের কলেজ রোড এলাকার এক মন্দিরের পুরোহিত বিজয় চক্রবর্তী, পিরোজপুর কেন্দ্রীয় কালী মন্দিরের পুরোহিত সলিল মুখার্জি সাবু, পালপাড়া দুর্গা-কালী মন্দিরের পুরোহিত রুহিদাস পাল এবং পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ফুলতলা এলাকার মন্দিরের পুরোহিত সেবায়েত পরিতোষ সাহা (৭০)।

এদের মধ্যে সেবায়েত সাহাকে সশরীরে এবং অন্যদের চিঠির মাধ্যমে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকেই স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।

বিষয়টি ওইসব মন্দির ও তার আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী হিন্দু পরিবারের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

পুলিশ বলছে, হুমকির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি তাঁদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে হুমকিপ্রাপ্ত পুরোহিত সলিল মুখার্জি সাবু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন জানিয়ে বেনারকে বলেন, “সোমবার মন্দিরের ভেতরে পড়ে থাকা একটি খাম খুলে দেখি, আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছি। তাঁরা নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন।”

মন্দির এলাকা ও পুরোহিতদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। চিঠিগুলোর বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পিরোজপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মৌসুমের রহমান বিশ্বাস।

এসব হামলা ‍ও হত্যার হুমকিকে ব্যক্তিগত আক্রোশ বলে উড়িয়ে দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী।

তিনি বলেন, “এসব হামলা ও হুমকির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ—সবকিছুর ওপর কোনো না কোনোভাবে হামলা চালানো হচ্ছে। এটাও কোনো না কোনোভাবে উগ্রবাদ ও মৌলবাদ।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।