বাংলাদেশে আবারও পৈশাচিক কায়দায় শিশু হত্যা

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.08.04
BD-child খুলনার টুটুপাড়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা রাকিব হত্যার প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামে। ৪ আগষ্ট,২০১৫
বেনার নিউজ

এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যাকাণ্ডের ক্ষত না শুকাতেই বাংলাদেশে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছে রাকিব নামের আরেকজন শিশু।

দেশব্যাপি ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ, গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে চলছে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও তোলপাড়। সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে পৈশাচিক কায়দায় রাকিব হত্যার কাহিনী।খুলনার টুটুপাড়ার বাসিন্দারা ঘটনার প্রতিবাদে নেমেছে সড়ক অবরোধে। নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে জনতা।

১২ বছর বয়সী রাকিবের মলদ্বার দিয়ে কমপ্রেসর মেশিনের মাধ্যমে বাতাস ঢুকানো হলে পেটের নাড়িভুড়ি ও ফুসফস ছিড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। এক কর্মস্থল ছেড়ে অন্য কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার অপরাধে সোমবার বিকেলে বাংলাদেশের খুলনা মহানগরীর একটি মোটর গ্যারেজে পৈশাচিক কায়দায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়।


যা ঘটেছিল

স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরা থেকে আসা নিহত রাকিব খুলনা মহানগরীর সেন্ট্রাল রোডের একটি বস্তিতে বাবা মায়ের সঙ্গে বসবাস করত। অভাবের সংসারে কোন রকমে খেয়ে পরে বাঁচার জন্য দেড় বছর আগে ৪র্থ শ্রেণিতে পড়া রাকিবকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে ‘শরীফ মটরস’ নামের গ্যারেজে কাজে দেন তার হতদরিদ্র বাবা নূর আলম হাওলাদার। কিন্তু সেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরেও প্রতিদিনই গ্যারেজ মালিকের কাছে গালমন্দ আর মার জুটত শিশুটির কপালে। কিছুদিন আগে তাই রাকিব ওই গ্যারেজ ছেড়ে অন্য আরেকটি গ্যারেজে কাজ নেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয় আগের গ্যারেজের মালিক ওমর শরিফ।

খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, “কাজ ছেড়ে দেওয়ায় রাকিবের উপর ক্ষুব্ধ ছিল শরীফ ও তার কর্মচারি মিন্টু।
রাতে গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবকে ডেকে নেয় সে। একপর্যায়ে শিশুটিকে বিবস্ত্র করে তার মলদ্বারে টায়ারে হাওয়া দেওয়ার পাইপ ঢুকিয়ে দেয় তারা। এতে রাকিবের পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ফেঁপে ওঠে।”

ওই সময় রাকিব অসুস্থ হয়ে পড়লে শরীফ ও মিন্টু তার পেটে চাপ দিয়ে বাতাস বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা শিশুটিকে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্লিনিকে ভর্তি করায় বলে পুলিশ জানায়।

সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাকিবকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর হয়। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর পরপরই মারা যায় শিশু রাকিব।

চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সুকুমার বলেন, “রাকিবের শরীরে অস্বাভাবিক পরিমাণ হাওয়া প্রবেশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুড়ি ছিড়ে যায়, ফুসফুস ফেটে যায়। এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো হয়ে গেলে সে মারা যায়।”


দায়ী বিচারহীনতা আর বিকৃত মানসিকতা

শিশুদের প্রতি এমন নির্মমতাকে ‘বিকৃত মানসিকতা’ বলে অভিহিত করেছেন অপরাধ ও মনোবিজ্ঞানীরা। সমাজে ‘মাসলম্যানদের’  আধিপত্য আর বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এর জন্য দায়ী বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

অধিকার বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “দেশের প্রায় প্রতিটি কর্মজীবী শিশু প্রতিদিন কোন না কোনভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু মিডিয়াতে আসছে শুধুমাত্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো”।
মানুষের নৈতিক অবক্ষয়, পেশি শক্তির প্রয়োগের প্রবণতা, বিচারহীনতা আর শিশু আইন সম্পর্কে সর্বসাধারণের অজ্ঞতা এসব ঘটনার জন্য দায়ী। দ্রুত বিচারের মাধ্যমে যদি রাজন কিংবা রাকিব হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায় তাহলেই এ ধরণের ঘটনা কমে আসবে বলে মত দেন তিনি।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বেনারকে বলেন,  “সমাজে আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বাড়ছে। হিংস্রতা বাড়ছে। এছাড়া অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে গণমাধ্যমের মানুষ নিত্যদিন এধরনের ঘটনাও দেখছে। সেসব দেখেই তাদের ভেতরকার অপরাধ প্রবণতা জেগে উঠছে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ এ ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সামাজিক অনুশাসন জোরদারকরণের মাধ্যমেই কেবল সুস্থ্য সমাজ গঠন সম্ভব।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ কামালউদ্দিন আহমেদ বলেন,  “এক ধরনের বিকৃত মানসিকতার মানুষ অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ অনুভব করেন। শিশু রাকিব হত্যার ক্ষেত্রেও সেটি ঘটেছে”।

তাঁর মতে, দিনে দিনে মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা কমে যাচ্ছে। জিংঘাংসা চরিতার্থ করতে তারা যা ইচ্ছা তাই করছে। মানুষের অপরাধ দমনের জন্য আইনের প্রয়োগ দরকার। দেশে যদি আইনের ব্যবহার কড়াকড়ি হত, তাহলে মানুষের মধ্যকার এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমে যেত।


ফুঁসছে গোটা দেশ

একবিংশ শতাব্দির আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে একজন শিশুর উপর এমন নারকীয় নির্যাতনের ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় জনতা। দোষীদের বিচারের দাবিতে ক্ষোভে ফেটে পড়া জনগণ সড়ক অবরোধও করে।

ঘটনার বর্বরতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাও। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝি বলেন,  “আমার দীর্ঘ পেশাগত জীবনে আমি এমন নৃশংস ঘটনা কখনো দেখিনি।”

দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিয়ে ঘটনায় তদন্তে তিন সদস্যের একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও বলেন তিনি।


ভয়ঙ্কর এ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী আরেক শিশু

ওই গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শিশু রাকিবের আর্তচিৎকার শুনতে পায় তারই এক খেলার সাথী ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র নাবিল (১০)। বর্বরোচিত এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সে বেনারকে জানায় বাচাঁর আকুতি নিয়ে রাকিব বলে,  “মামা আর দিয়েন না, আমি মরে যাবো।”  এক পর্যায়ে বমি করতে থাকে রাকিব। রাকিবকে চেপে ধরে তারা উল্লাস করে। এতে রাকিবের পেটসহ শরীরের অনেক জায়গা ফুলে ওঠে। দৃশ্য দেখে নাবিল বাড়িতে রাকিবের পরিবারকে ঘটনাটি জানায়। পরিবারের সদস্যরা তৎক্ষনাৎ ছুটে গিয়েও তারা শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারেনি।


বিচার চান রাকিবের মা

রাকিবের বাসায় মা লাকি বেগম বলেন, খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে যাই। তখনও ওর কিছুটা জ্ঞান ছিল। সে আমাকে বললো “মা আমারে বাঁচাও। মামা আমারে অনেক কষ্ট দিছে। পেটের ভেতরে বাতাস ঢুকায়ছে। আমি বাঁচবো না, মা।”

সন্তান হারা এই মা বলেন,  “আমার বাচ্চাটার ফুসফুস, পেটের নাড়িভুড়ি ছিড়ে যায়। এমন নির্যাতন পশুর প্রতিও কেউ করেনা। আমি ওইসব পিশাচদের বিচার চাই।”


তিনজনকে আসামি করে মামলা

স্থানীয় জনতার হাতে গণপিটুনির শিকার মিন্টু মিয়া ও শরীফকে পুলিশ পাহারায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ঘটনায় নিহত রাকিবের বাবা নুরুল আলম হাওলাদার খুলনা সদর থানায় তিনজনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলার তিন আসামিরা হলেন- গ্যারেজ মালিক ওমর শরীফ (৩৫), সহযোগী মিন্টু মিয়া (৪০), ও শরীফের মা বিউটি বেগম (৫৫)। স্থানীয় জনতা তিনজনকেই আটক করে পুলিশে দিয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।