জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধ সমালোচিত

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.09.06
20160906-BD-Crossfire1000.jpg জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যায় অভিযুক্ত আব্দুস সবুরকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার আগে ও পরে এ বছর অন্তত ৯৮ ব্যক্তি পুলিশ, র‍্যাব, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানের কোনো কোনো ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত গ্রেপ্তারের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ারে ৬৬ জন নিহত হয়। ওই একই সময়ে গ্রেপ্তারের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ১৩ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়।

এই ৭৯ জন ছাড়াও ঢাকার কল্যাণপুর, মিরপুরের রূপনগর ও নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় মোট ১৩ জঙ্গি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। ঢাকার বাইরে রাজশাহী, গাইবান্ধা, বগুড়া ও টাঙ্গাইলে পুলিশের ক্রসফায়ারে আরও ছয়জন মারা যায়।

অভিযানের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পাল্টা বলেছেন, ‘শিক্ষিত, ইয়াং ছেলেদের’ ধরে ধরে মারা হচ্ছে।

ক্রসফায়ারে নিহতদের মধ্যে তিনজন পুলিশের পুরস্কার ঘোষিত আসামি। পুরস্কার ঘোষণার এক মাসের মাথায় গত ১৮ জুন নিহত হয় বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়সহ ব্লগার, লেখক ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের খুনের জন্য দায়ী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার শীর্ষ নেতা মুকুল রানা।

পুরস্কার ঘোষণার চারদিনের মাথায় ১ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলার আসামি ও আইএস মতাদর্শী নিউ জেএমবি নেতা ‘বাইক হাসান’ এবং পুরস্কার ঘোষণার ২৫ দিনের মাথায় গত ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় নিহত হয় নিউ জেএমবির সমন্বয়ক তামীম আহমেদ চৌধুরী।

একই সময়ের মধ্যে গুলশানের হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠীর গুলিতে চার পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। আহত হন আরও প্রায় ৩০ জন।

সন্দেহভাজন জঙ্গিদের বন্দুক যুদ্ধের নামে খুঁজে বের করে হত্যা করা হচ্ছে—এমন অভিযোগ পুলিশ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। গত শনিবার রাজশাহী মহানগর পুলিশের ২৪ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত জঙ্গিবাদবিরোধী মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, “অনেকে জঙ্গিদের মানবাধিকারের কথা বলেন; জঙ্গিদের আবার কিসের মানবাধিকার?”

তিনি আরো বলেন, 'আগে দেশকে বাঁচাতে হবে, জনগণকে বাঁচাতে হবে। সব বিষয়ে বিরোধিতা করলে হবে না'।

রাজশাহী পুলিশ লাইনস মাঠে আয়োজিত ওই সমাবেশে আইজিপি বলেন, “ওর (জঙ্গি) কাছে বোমা আছে, ওর আগ্নেয়াস্ত্র আছে, ধারালো অস্ত্র আছে, তাকে আদর দিয়ে তো গ্রেপ্তার করা যায় না”।

“কল্যাণপুর ও নারায়ণগঞ্জে আমরা জঙ্গিদের অনেক সময় দিয়েছি। কিন্তু তারা আত্মসমর্পণ করেনি। উল্টো পুলিশকে বোমা মেরেছে, গুলি করেছে,” বলেন আইজিপি।

জঙ্গি দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম এবং অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেনও ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে সমালোচনা করায় আক্ষেপ করেছেন।

তাঁরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অভিযানগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দুজনেরই মন্তব্য পুলিশ নিহত না হলে অনেকেই অভিযানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এটা দুঃখজনক।

যেভাবে শনাক্ত হচ্ছে জঙ্গি আস্তানা

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “পুলিশের অভিযান তো বন্ধ নেই। এর মধ্যেই বহু জঙ্গিকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। প্রত্যেকের কাছ থেকে টুকরো টুকরো তথ্য নিয়েই আমরা একেকজন জঙ্গিকে শনাক্ত করছি।”

তিনি আরও বলেন, “এই মুহূর্তে পুলিশের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য আছে। কাজ করে শেষ করা যাচ্ছে না।”

পুলিশ জানায়, মিরপুরের রূপনগরে নিউ জেএমবির প্রধান অস্ত্র প্রশিক্ষক কথিত মেজর মুরাদ বা জাহাঙ্গীর সম্পর্কে তারা তথ্য পায় শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলাকারী শফিউল ও হোসেনি দালানে মহররমের তাজিয়া মিছিলে হামলাকারী জঙ্গিদের কাছ থেকে।

অপরাধী তার চিহ্ন রেখে যায় বলে যে কথা প্রচলিত আছে সে কথা মিরপুরের রূপনগরের অভিযানের ক্ষেত্রে সত্য হয়েছে বলে জানায় পুলিশ।

নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় পুলিশ একটি ভাড়াটিয়া তথ্য ফরম খুঁজে পায়। সেখান থেকেই ওই বাড়ির ঠিকানা মেলে। যদিও সে সময় নাম সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত হয়নি।

অবশ্য অভিযানের একদিন পর ৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় পরিচয় পত্রে থাকা আঙুলের ছাপ নির্বাচন কমিশনে সংরক্ষিত ডেটার সঙ্গে মিলিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় মেজর মুরাদ বা জাহাঙ্গীর আসলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম।

গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর পুলিশের সবচেয়ে বড় অভিযান ছিল কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ির অভিযান। অপারেশন স্টর্ম ২৬ নামের ওই অভিযানে নয় জঙ্গি নিহত হয়েছিল। অভিযানের পরপরই অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন জায়গা থেকে জঙ্গিদের ধরে এনে ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে রাখা হয়। তারপর পুলিশ অভিযান চালায়।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ছানোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল কল্যাণপুরের কোথাও জঙ্গি আস্তানা আছে। কিন্তু আমরা বাড়িটি চিহ্নিত করতে পারছিলাম না। মিরপুর ডিভিশনের পুলিশ ব্লক রেইডের অংশ হিসেবে ওই রাতেও রেইড দিয়ে বাড়িটির সন্ধান পায়। ঘটনাটি সাজানো নয় বলেই ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় একজন উদ্ধার হয়েছে। একজন পালিয়ে গেছে।”

নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার বাড়িটি সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে জেএমবির দলত্যাগী এক সদস্য, এমনটাই দাবি করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

মনিরুল ইসলাম বলেন, “কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলা জঙ্গিদের মধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানের মুখে অনেকে টিকতে না পেরে তথ্য দিচ্ছে। এসবই পরের অভিযানগুলোয় সফলতা এনে দিয়েছে।”

কথিত বন্দুক যুদ্ধ নিয়ে সমালোচনা

গত ১৮ জুন মাদারিপুরের কলেজ শিক্ষক রিপন চক্রবর্তী হত্যা চেষ্টা মামলায় রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম (১৯)।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার সারওয়ার হোসেন সে সময় বলেন, সদর থানার মিয়ারচর এলাকায় পুলিশ ফয়জুল্লাহকে নিয়ে অভিযানে যায়। ফয়জুল্লাহর সহযোগীরা সেখানে অবস্থান করছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে তারা গুলি ছোড়ে। গোলাগুলিতে ফয়জুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়।

১৮ জুন দিবাগত রাতেই বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় মুকুল রানা। ১৯ মে ডিএমপি তার নাম শরীফুল বলে জানায় ও ছবি প্রকাশ করে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার নাম মুকুল রানা এই তথ্য পুলিশের জানা ছিল না।

এ ধরনের কথিত বন্দুকযুদ্ধের বিষয় কতটা স্বাভাবিক—জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বেনারকে বলেন, “পুলিশ প্রকৃত পরিচয় না-ও জানতে পারে। নিষিদ্ধ বা গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের অসংখ্য নাম থাকে।”

পরপর দুটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় সে সময় সাধারণ মানুষের অনেকেই সমালোচনা করেন। অনেকেরই যুক্তি ছিল বাঁচিয়ে রাখলে তাদের কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়া যেত।

তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই জেএমবির শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে এদেরও বিচার সম্ভব।

তবে ক্রসফায়ারে মৃত্যু ঘিরে সমালোচনার তীব্রতা কমে ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর। ওই ঘটনার পর জঙ্গিদের ক্রসফায়ারে নিহত হওয়া নিয়ে বিরাট সংখ্যক মানুষের মধ্যে স্বস্তি দেখা গেছে।

মানবাধিকার সংগঠন ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর দলের নেতা–কর্মীরা ছাড়া আর কেউ এ অভিযানগুলোর প্রকাশ্য সমালোচনা সে অর্থে করেননি।

“র‍্যাব প্রতিষ্ঠার পরও মানুষ একইভাবে উল্লাস করেছে। কিন্তু লিমনের ঘটনা মানুষের চোখ খুলে দেয়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যদি নিজের হাতে আইন তুলে নেয় তাহলে বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে,” বেনারকে জানান আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন। তিনি বলেন, ‘বিনা বিচারে মৃত্যু কাম্য নয়’।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।