ছিটমহলের উন্নয়নে চাওয়া–পাওয়ার হিসাব কষা হচ্ছে
2015.08.03

বাংলাদেশের সঙ্গে সদ্য সংযুক্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে অগ্রাধিকারমূলক সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর কার্যক্রম গ্রহণের জন্য সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ছিটমহলের উন্নয়নে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে চলতি জাতীয় বাজেটে। গত জুনের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই বরাদ্দ প্রস্তাব করেন।
তবে এই বাজেট মোটেও পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন ছিটমহলের নেতারা। তাঁদের মতে, এত যুগ ধরে যেখানে উন্নয়ন হয়নি, সেখানে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ দরকার।
“আমাদের হিসেবে ছিটমহলের উন্নয়নে এখনই কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা দরকার। যদি পিছিয়ে পড়া মানুষদের উন্নয়নের ধারায় আনা সরকারের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে এই বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে,” বেনারকে জানান ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি (বাংলাদেশ ইউনিট) সভাপতি মইনুল হক।
এদিকে গত ২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ৬৮ বছর পর দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতাসহ ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব এলাকায় বসবাসরত ভাগ্যহত ও সুবিধাবঞ্চিত জনগণের মানোন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার।
“আমরা দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব এলাকার মানুষের জন্য অগ্রাধিকারমূলক সিএসআর কার্যক্রম গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি। এ সংক্রান্ত নির্দেশনার চিঠি সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে এবং অবিলম্বে তা কার্যকর হোক এটাই বাংলাদেশ ব্যাংক চায়,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মনোজ কুমার বিশ্বাস।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ২০১২-১৩ অর্থ বছরে সিএসআর খাতে ব্যাংকগুলোর ব্যয় ছিল ৩০৫ কোটি টাকা যা এখন আরও বেড়েছে।
এদিকে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা- তা তদারক করতে ‘নজরদারি’ বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন গভর্নর আতিউর রহমান।
গত ১৫ মার্চ একটি বেসরকারি ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা মানবিক দায়বোধ সম্পন্ন ব্যাংকিং খাত দেখতে চাই। এ জন্যে সিএসআর কার্যক্রমের প্রতি অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।”
“ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফার সামান্য একটি অংশ সিএসআর খাতে ব্যয় করলেও দেশের অনগ্রসর ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণ হবে বলে আমার বিশ্বাস,” উল্লেখ করেন ড. আতিউর।
একটি জেলার ছিটমহলের উন্নয়নে হিসাব-নিকাশ
সরকার ছিটমহলগুলোতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করে সেগুলোকে উন্নয়নের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিতে চায়। এ লক্ষ্যে কত টাকা খরচ হবে, সেই প্রাক্কলন শেষ হয়নি। তবে জেলা প্রশাসন থেকে প্রাক্কলন শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসন উন্নয়নকাজে বরাদ্দের প্রাক্কলন শেষ করেছে। জেলার ১২টি ছিটমহলের ৩৬ ছিটের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসন। ইতিমধ্যে এই বরাদ্দ প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।
“পঞ্চগড় থেকে যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, তা বিভাগীয় কমিশনার যাচাই-বাছাই করে সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। আশা করা যায় সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই প্রস্তাব অনুমোদন করবে,” বেনারকে জানান পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
ওই অঞ্চল ঘুরে এসে ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক জানান, পঞ্চগড়ের ছিটগুলো ঘুরে তিনি সেখানে কোনো কলেজ বা বিদ্যালয় খুঁজে পাননি। সেখানে নেই কোনো পাকা সড়ক ও সেতু। নিজেদের উদ্যোগে ছিটমহলবাসীরা যেসব কাঁচা রাস্তা তৈরি করেছে, সেগুলোও নাজুক। নেই সুচিকিৎসার ব্যবস্থা।
৩১ জুলাই দিবাগত মধ্যরাত থেকে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ের ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের অংশ হয়ে গেছে। এর মধ্যে পঞ্চগড়ের ছিটমহলের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ২০ হাজার।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের নথি থেকে জানা গেছে, ছিটমহলের ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণের জন্য ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। জমি আছে, অথচ বাড়ি নেই এমন ৫০টি পরিবারকে গৃহ নির্মাণ বাবদ দেড় কোটি টাকার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন প্রকল্পের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, অতি দরিদ্র পরিবারকে গরু মোটাতাজারণ ও সেলাই মেশিন চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশের আইন-কানুন সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ এবং সরকারি চাকরিতে যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থীদের জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে।
ছিটমহলবাসীদের জমি নিয়ে যাতে কোনো ধরনের বিরোধের সৃষ্টি না হয়, সে জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বিশেষ কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ছিটমহলের মধ্যে থাকা সরকারি খাস জমি ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়ার সুপারিশ করেছে। ৩৬টি ছিটে ভূমি জরিপ পরিচালনার জন্য ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চারটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং দুটি কলেজ নির্মাণের জন্য ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ও মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী বাবদ ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে।
ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা চিহ্নিত করে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে মেরামত করা এবং ৪০ দিনের কর্মসূচির মাধ্যমে অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দিয়ে পাঁচটি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং তিনটি পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। ছিটমহলের কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হয়েছে ৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য চাওয়া হয়েছে ২৫ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার। এ টাকায় ৪৭ কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হবে। পয়ঃপ্রণালি ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে ২৭ কোটি ৫০ টাকা চাওয়া হয়েছে। ছিটমহলবাসীদের নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে চাওয়া হয়েছে ২৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। বিদ্যুতের ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য চাওয়া হয়েছে ১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
এ ছাড়া বনায়নের জন্য ৩৩ লাখ টাকা। হাঁস-মুরগী ও গবাদি পশু পালন এবং এর প্রশিক্ষণের জন্য ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে।
“আমরা এখন সরকারের উন্নয়ন আশ্বাস দেখার অপেক্ষায় আছি। মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা তার সবকটির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে,” টেলিফোনে বেনারকে জানান সিরাজুল ইসলাম, যিনি পঞ্চগড়ের চারটি ছিট নিয়ে গঠিত কাজলদিঘী–দিনবাজার পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি আরও জানান, তাঁর বাপ–দাদারাও এই ছিটে বসবাস করেছেন।
ভারতে বিবাদ, ক্ষুব্ধ মমতা
এর মধ্যেই পুনর্বাসনের টাকার অঙ্ক নিয়ে বিবাদ শুরু হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে।
ভারতের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার জানিয়েছে, বাংলাদেশের ছিটমহলগুলো থেকে আসা মানুষের পুনর্বাসনে তিন হাজার আট কোটি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মোদী সরকার। কিন্তু এখন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানিয়েছে, তারা এখন ৫০ কোটি টাকার বেশি দিতে পারছে না। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ রাজ্য সরকার।
একই খবরে উল্লেখ করা হয়, তবে রাজ্য সরকারের সঙ্গে জটিলতা যাতে বেশি দূর না গড়ায়, সে দিকে নজর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর সচিবালয়ের মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে, কেন্দ্র আলোচনা করে বিষয়টির সমাধানে আগ্রহী।
সে ক্ষেত্রে এ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি গেলে তাঁর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বৈঠক হতে পারে।