নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিকার পাওয়ার পথ খুঁজে দিচ্ছে ১০৯২১
2015.08.03

পরিবার ও সমাজে নারীরা নানাভাবে নির্যাতিত হওয়ার পর কোথায় যাবে, কাকে বলবে, প্রতিকার পেতে চাইলে টাকার জোগান আসবে কোথা থেকে—এমন হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় ভুক্তভোগীদের মধ্যে। এই অসহায় অবস্থা থেকে উদ্ধারে একটি টোল ফ্রি নম্বর নিয়ে এগিয়ে এসেছে সরকারেরই একটি প্রকল্প।
প্রকল্প সূত্র জানায়, নম্বরটি দিনদিন যত বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে, ততই বাড়ছে প্রতিকার পাওয়া নির্যাতিত নারী ও শিশুর সংখ্যা। এখন গড়ে প্রতিদিন প্রায় এক শ ফোন আসে প্রতিকার চেয়ে।
২০১২ সালের ১৯ জুন থেকে জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার এই সেবা চালু করেছে। বাংলাদেশ সরকার ও ডেনমার্ক সরকারের যৌথ উদ্যোগে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে নম্বরটি চালু করা হয়।
ঢাকার ইস্কাটনে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কার্যালয়ে এ সেন্টারের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ১০৯২১ নম্বরটি হেল্পলাইন হিসেবে দিয়েছে, যাতে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে এই নম্বরে ফোন করা যায়।
গত বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস থেকে এই নম্বরে ফোন করতে কোনো চার্জ লাগছে না।
“শুধু নিজে নির্যাতনের শিকার হলেই নয়, আশপাশের কাউকে নির্যাতনের শিকার হতে দেখলে বা শুনলেও সে তথ্য জানিয়ে দিতে পারবেন এই নম্বরে। এ ক্ষেত্রে তথ্যদাতার নাম পরিচয় সতর্কতার সঙ্গে গোপন রাখা হয়,” বেনারকে জানান শায়লা ইয়াসমিন, যিনি ওই প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়কারী।
তিনি জানান, নির্যাতনের শিকার হলে কোথায় যেতে হবে, কোন ধরনের নির্যাতনের জন্য কোন ধরনের আইনি সহায়তা নিতে হবে ইত্যাদি পরামর্শ জানা যাবে নম্বরটিতে। শুধু পরামর্শ নয়, বিনা মূল্যে পাওয়া যায় কাউন্সেলিং সেবাও।
সোমবার ওই নম্বরের মাধ্যমেই যোগাযোগ করা হয় শায়লা ইয়াসমিনের সঙ্গে। ১০৯২১ নম্বরে ফোন করে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তথ্য জানতে চাইলে প্রকল্প সমন্বয়কারীকে সংযোগ দেওয়া হয়।
শায়লা জানান, দেশের যেকোনো মুঠোফোন বা টেলিফোন থেকে ১০৯২১ নম্বরে ডায়াল করে যিনি ফোন ধরবেন তাঁকে প্রথমে জানাতে হবে নির্যাতনের তথ্য। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে থানা ও পুলিশকে জানানো সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
“আমরা সাধারণত মামলা করতে উৎসাহিত করি না। প্রথমে সালিসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হয়। তারপরও কেউ মামলা করতে চাইলে এবং পরিস্থিতি সেই পর্যায়ে গেলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় মহিলা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়,” জানান নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন।
প্রকল্প পরিচালক জানান, বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গেও নির্যাতিতদের যোগাযোগ করানো হয়।
প্রকল্প সূত্র জানায়, এই নম্বরে আসা বেশির ভাগ অভিযোগের মধ্যে থাকছে স্বামী কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে, প্রেমিকের প্রতারণা, ছবির অপব্যবহার, ভাই কর্তৃক বোনকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা ইত্যাদি।
“অনেকে আবার সেবা চান না। তাঁরা মনের কথা বলে ও ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজেকে হালকা করেন,” বেনারকে জানান ওই কেন্দ্রের একজন কর্মী, যিনি একজন আইনজীবী হলেও নাম প্রকাশ করতে চান না।
প্রকল্প সূত্র জানায়, কেন্দ্র থেকে নির্যাতিতদের তথ্য প্রকাশ করা হয় না, তবে রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়।এমন একটি রেকর্ড থেকে জানা যায়, চাঁদপুরে চার বছরের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে মা দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি এই নম্বরে ফোন করলে সেই মাকে বলা হয়, তিনি যেন মেয়েকে গোসল না করান এবং কাপড় না ধুয়ে ফেলেন। কিন্তু ততক্ষণে মা এ কাজগুলো করে ফেলেছেন।
এরপর মাকে পরামর্শ দেওয়া হয়, মেয়েকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করে মামলা-সংক্রান্ত বিষয়ে সহায়তা দেওয়া হয় সেই মাকে। মামলাটি এখনো দেখভাল করা হচ্ছে কেন্দ্র থেকে।
“দিশেহারা মুহূর্তে কেন্দ্র থেকে পাওয়া পরামর্শ এবং সেবা খুবই কাজে দিয়েছে,” এক প্রতিক্রিয়ায় ওই প্রকল্পকে জানান সেই মা।
এদিকে প্রকল্পের পক্ষ থেকে যেসব প্রচার চালানো হচ্ছে, তা হলো-আপনি শারীরিক, মানসিক, হয়রানিমূলক, যেকোনো রকম নির্যাতনের শিকার হলে ফোন করুন। আপনার পাশের বাসায় বউ পিটানো হচ্ছে এবং কাজের মেয়েকে ছেঁকা দিচ্ছে আগুনের, মানবিকতার তাগিদে ফোন করুন, আপনার পরিচয় গোপন করা হবে।
আরেকটি প্রচার হচ্ছে, “আপনি একজন মেয়ে, মামলা করতে গেছেন। পুলিশ নিচ্ছে না মামলা, উল্টো হ্যারাস করছে। ফোন করুন।”
“তবে কারও বিরুদ্ধে ইচ্ছা করে মিথ্যা তথ্য দিলে, মিথ্যা মামলা করলে অর্থাৎ এই সুবিধার অপব্যবহার করা হলে, তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যদিও এমন নজির খুব একটা নেই,” জানান প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন ।
উদ্যোগটি ভালো হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নারী ও শিশু নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব প্রতিষ্ঠানের মতে, এখনো অনেকে নম্বরটি সম্পর্কে জানে না।
আবার পাঁচ ডিজিটের নম্বর সবাই মনে রাখতে পারে না বিধায় তিন ডিজিটের সহজ নম্বর চালু করার প্রস্তাব তাঁদের।
“এর ব্যাপক প্রচার দরকার এবং ফোনের ওই প্রান্তে যারা থাকবে তাদের দক্ষ, যোগ্য ও ধৈর্যশীল হতে হবে,” বেনারকে জানান আইনজীবী সালমা আলী, যিনি জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি।
তাঁর মতে, উদ্যোগটি খুবই ভালো, কিন্তু এটাকে আরও কার্যকর করতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে হলে সহজে মনে রাখার মতো নম্বর দেওয়া জরুরী বলে মনে করেন তিনি।