আরও হামলার আশঙ্কায় সতর্ক থাকতে বললেন প্রধানমন্ত্রী
2016.07.13

এতোদিন সরকারের মন্ত্রী ও সরকার দলীয় নেতারা আরও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিলেন। এবার প্রকাশ্যে একইরকম আশঙ্কার কথা জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আগামী ১৫ ও ১৬ জুলাই মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোরে অনুষ্ঠিতব্য ১১তম এশিয়া-ইউরোপ শীর্ষ সম্মেলনে (আসেম) যোগ দিতে বৃহস্পতিবার ঢাকা ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বললেন।
উল্লেখ্য, আসেম হচ্ছে ৫১টি এশিয়া ও ইউরোপের দেশ ও দু’টি আঞ্চলিক সংস্থার একটি ফোরাম। বাংলাদেশ ২০১২ সালে ওই ফোরামে যোগ দেয়।
সেখানে প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার সুইস প্রেসিডেন্ট জন স্কনেইদার, রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেব, জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো জেন্টিলোনির সঙ্গে আলাদা বৈঠক করবেন।
গত ১ জুলাই গুলশানে একটি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় জাপান ও ইতালির ১৬ জন নাগরিক নিহত হওয়ার পর ওই দুটি দেশের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে দেখা হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। সেখানে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য অনেককে সতর্ক করার পাশাপাশি ভাবিয়ে তুলেছে।
সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীরা দেশে আরও হামলার পরিকল্পনা করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “হয়তো দেখা যাবে একইসাথে সাত-আটটি জেলায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালাতে পারে। সেখানে জনপ্রতিনিধি থাকতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা থাকতে পারে।” পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সশস্ত্র বাহিনী, মন্ত্রী, সাংবাদিক বা বিদেশি নাগরিকদের ওপর আক্রমণ চালাবার একটা পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
গত সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে তাঁর সহকর্মীদের সতর্ক করেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রত্যেককে সতর্ক থাকতে বলেন, এর পাশাপাশি অন্যদের সতর্ক করারও পরামর্শ দেন।
প্রধানমন্ত্রী ওই পরামর্শ দেওয়ার পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন বিভাগ ও দপ্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের নিয়ে উদ্বুদ্ধকরণ সভা হচ্ছে।
“আমরা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের নিয়ে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরপরই সভা করি। এসময় সবাইকে সতর্ক থাকা ও অন্যদের সতর্ক করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়,” বেনারকে জানান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ যে এই অবস্থায় আসবে এটা অনেক আগেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসন ও পুলিশ হয়তো এতোটা ভাবতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল তাঁর সরকারি বাসভবন থেকে কয়েকটি জেলার সরকারি প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বক্তব্য দেন। গত মঙ্গলবারও তিনি কয়েকটি জেলার কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন।
দুটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব ‘পরিকল্পিত জঙ্গি হামলার’ সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী সংশ্লিষ্টদের যোগসূত্রের কথা বলেন। তিনি এসব হামলায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ‘সম্পৃক্ততার’ সম্ভাবনার কথাও জানান। যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যরা জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
“যে সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের আমরা বিচার করছি তাদের পরিবার পরিজনেরা আছে। এরা কিন্তু থেমে নেই। তারাও কিন্তু ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এমনকি তারা কেউ দেশে-বিদেশে রয়েছে। তাদের অর্থ সম্পদের কোনো অভাব নাই,” সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী।
উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত ও বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এখন যার ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন তিনি জামায়াতের শীর্ষনেতা ও ধনকুবের মীর কাসেম। তার ফাঁসি কার্যকরের আগে আরও কিছু ঘটনা ঘটবে বলে রাজনীতিবিদদের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে।
“এই পরিস্থিতিতে জামায়াত–শিবির বসে থাকবে, এটা ভাবা উচিত নয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ওদের নেতাদের একে একে সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি হবে, আর ওরা তা সহজে মেনে নেবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই,” বেনারকে জানান ১৪ দলের সমন্বয়ক ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
তিনি বলেন, ওদেরকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ইউনিয়ন পর্যায়ে সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়েছে, যে কমিটিতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিরা থাকবেন।
গতকাল প্রধানমন্ত্রীও সব শ্রেণি-পেশার ও স্তরের মানুষকে নিয়ে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ বিরোধী কমিটি করে এবং কমিউনিটি পুলিশিংকে আরও শক্তিশালী করে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এই কমিটির কার্যক্রম ব্যাপকভাবে পরিচালনার নির্দেশ দেন।
“সবাইকে আরও সচেতন থাকতে হবে। কারণ এটাও মনে রাখতে হবে যে, এটা এখানেই থামবে না,” জানান শেখ হাসিনা। তিনি আরও বলেন, নানা ধরনের পরিকল্পনা আছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া তথ্য থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৫ সালের তিন মাস বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সহযোগীরা মিলে সারাদেশে অগ্নিসন্ত্রাস ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যার মত জঘন্য কার্যক্রম করেছিল। এরা থেমে থাকবে না। তারা জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েই কাজ করবে বলে মনে করেন তিনি।
সশস্ত্র বাহিনীকেও সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি আহ্বান করব, তাঁরাও যেন তাঁদের কর্মক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন থাকে এবং সন্ত্রাসবিরোধী প্রচার-প্রচারণা এবং যে কোনো ব্যবস্থা যেন তাঁরা গ্রহণ করে।”
বুধবার সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। আগের দিন ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময় করেন তিনি।
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোকে ‘লজ্জাজনক ঘৃণ্য অপরাধ’ আখ্যায়িত করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি জানি না তারা (জঙ্গিরা) কী ধরনের মুসলমান। তারা কখনো ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারে না।।”
ইসলামকে শান্তির ধর্ম মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেই ধর্মকে তারা অবমাননা করছে, হেয় করছে, নিন্দিত করছে। এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু হতে পারে না।”
মসজিদের ইমাম, ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক, অভিভাবক, প্রসাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্য, সব ধরনের জনপ্রতিনিধি, সমাজ সেবক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান সম্পর্কে জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বেনারকে বলেন, “ইসলামিক ফাউণ্ডেশন জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে ইতিমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। দেশের আলেম–ওলামা ও মসজিদের ইমামদের এই কাজে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। সরকারের কাছ থেকে আরও কোনও ধরনের নির্দেশনা বা পরামর্শ পেলে তা বাস্তবায়নে ফাউণ্ডেশন প্রস্তুত আছে।”