অবশেষে রানা প্লাজা ধস মামলার বিচার শুরু
2016.07.18

তিন বছর পর অবশেষে সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা মামলায় বিচার শুরু হয়েছে। ২০১৩ সালে পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়া ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের সহস্রাধিক পোশাক শ্রমিক নিহত হন।
সোমবার ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ আসামির বিরুদ্ধে হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর দিন নির্ধারণ করেছেন ঢাকার জেলা দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস।
এর আগে গত জুন মাসে একই ঘটনায় সোহেল রানাসহ ১৮ আসামির বিরুদ্ধে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় বিচার শুরু হয়। আগামী ২৩ আগস্ট ওই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর কথা রয়েছে।
হত্যা মামলায় বিচার শুরু হওয়ায় কিছুটা সন্তোষ প্রকাশ করলেও সময়ক্ষেপণ ও দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শ্রমিক নেতা ও ক্ষতিগ্রস্তরা।
ছয়জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু
সোমবার অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৩৫ জন আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এ মামলায় মোট ৪১ আসামির বাকি ছয়জনকে পলাতক দেখিয়ে বিচার শুরু করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খন্দকার আবদুল মান্নান বেনারকে জানান, “আসামিদের ৩৮ জনকে হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাকিরা অন্যান্য ধারায় অভিযুক্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন।”
তিনি জানান, তবে প্রত্যেক আসামিই দায় অস্বীকার করে আদালতের কাছে নিজেদের ‘নির্দোষ’ দাবি করেছেন। এসময় সুবিচার প্রার্থনা করেন তারা।
গতকাল সোহেল রানাসহ ২৩ জনের পক্ষে মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদনও করা হয়। তবে শুনানি শেষে সে আবেদন খারিজ করে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা শুনানি শেষে আবেদন নাকচ করার সময় আদালত বলেন, “বাণিজ্যিক ভবনে কারখানা বসানো, ভবনের কাগজপত্রে জালিয়াতি, ভবন ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও জোর করে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করার জন্য আসামিদের ‘দোষ’ প্রমাণিত হয়েছে। তবে নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় বিচার শেষে নির্দোষ প্রমাণিত হলে খালাস পাবেন তারা।”
যারা আসামি
সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার ওই ঘটনার মামলাটির আসামিরা হলেন; ভবন মালিক সোহেল রানা, মা মর্জিনা বেগম, বাবা আব্দুল খালেক, রেফাত উল্লাহ, মোহাম্মাদ আলী খান, রফিকুল ইসলাম, বজলুস সামাদ আদনান, রাকিবুল হাসান রাসেল, আনিসুর রহমান, মাহমুদুর রহমান তাপস, আমিনুল ইসলাম, মো, অনিল দাস, সারোয়ার কামাল, উত্তম কুমার রায়, শাহ আলম, মোহাম্মদ আলী খান, আবুল হাসান ও রাকিবুল হাসান।
এছাড়াও রয়েছেন সাভার পৌরসভার সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, পৌর নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপ-প্রধান পরিদর্শক (সাধারণ, ঢাকা বিভাগ) মো. জামশেদুর রহমান, উপ-প্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, ঢাকা বিভাগের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. সহিদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিভাগের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. ইউসুফ আলী, রাজউকের ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন, ইথার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, মো. শফিকুল ইসলাম ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. ইউসুফ আলী মো. আতাউর রহমান, তসলিম, মো. আমিনুল ইসলাম, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, নান্টু কন্ট্রাকটার, রেজাউল ইসলাম, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ ও নয়ন মিয়া।
রানা প্লাজা ধস
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের সকালে ঢাকার উত্তরাঞ্চলের সাভার বাসস্ট্যন্ড সংলগ্ন রানা প্লাজা ভেঙে পড়ে। ওই সময় আট তলা ওই ভবনটিতে থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানার হাজার শ্রমিক কর্মরত ছিলেন।
ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় এক হাজার একশ ৩৫ জন শ্রমিক নিহত হন এবং আহত হন প্রায় সহস্রাধিক। ওই ঘটনার পর বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ প্রশ্নের মুখে পড়ে।
বিপুল প্রাণহানির ওই ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে শুরুতে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করে মামলা করেন তৎকালীন সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ।
পরে তদন্ত শেষে অভিযোগপত্রে সরকারি কর্মকর্তাসহ ৪১ জনকে আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মৃত্যুসহ বিভিন্ন ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
তবু ক্ষোভ, হতাশা
দেরিতে হলেও সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার ওই ঘটনায় হত্যা মামলার বিচার শুরু হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন শ্রমিক নেতারা। তবে ‘পরিকল্পিতভাবে’ হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামিরা আটক থাকার পরেও বিচার শুরু হতে তিন বছর লেগে যাওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করেন তাঁরা।
এ বিষয়ে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “খেটে খাওয়া, দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরানো হাজারো মানুষকে প্রাণ দিতে হলো কিছু মানুষের লোভ আর স্বার্থের কারণে। তারা আইনের হাতের কাছে থাকলেও আইন সঠিক গতিতে চলছে না। বিচার শুরু করতেই তিন বছর কেটে গেলে। এটা অত্যন্ত হতাশা বিষয়।”
তাঁর মতে, এমন ঘটনা দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি সাধারণ মানুষকে আস্থাহীন করে তোলে। আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আসামিদের বেরিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়।