জঙ্গি অর্থায়নে অভিযুক্ত ৪ বাংলাদেশিকে কারাদণ্ড দিয়েছে সিঙ্গাপুর আদালত

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.07.12
160712-BD-SG-motorcade-1000.jpg সিঙ্গাপুর রাজ্য আদালতের বাইরে পুলিশের একটি সাঁজোয়া গাড়ি বহর দেখা যাচ্ছে, যাতে করে সিঙ্গাপুরের আদালতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া চার বাংলাদেশিকে আদালতে হাজির করা হয়। জুলাই ১২, ২০১৬।
এএফপি

জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত চার প্রবাসী বাংলাদেশিকে দুই থেকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে সিঙ্গাপুরের আদালত। বাংলাদেশে সশস্ত্র জঙ্গিবাদ চালাতে অস্ত্র কেনার জন্য অর্থ সংগ্রহের দায় স্বীকার করেছে তারা।

দুই পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে আদালত মঙ্গলবার ওই চারজন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা করে। সিঙ্গাপুরের দৈনিক স্ট্রেইটস টাইমস অনলাইন, বার্তা সংস্থা এএফপি ও রয়টার্স সূত্রে এই খবর পাওয়া গেছে।

প্রবাসীদের জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতা দেশের শ্রমবাজারের জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে বাংলাদেশের বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদেশ পাঠানোর আগে থেকে শুরু করে কর্মরত থাকা অবস্থায় জঙ্গিবাদ বিষয়ে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে।

সাজাপ্রাপ্ত চার বাংলাদেশি হচ্ছে; মিজানুর রহমান (৩১), মো. জাবেদ কায়সার হাজি নুরুল ইসলাম সওদাগর (৩০), রুবেল মিয়া (২৬) ও ইসমাইল হাওলাদার সোহেল (২৯)।

গত ৩১ মে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সহায়তার জন্য কয়েক হাজার মার্কিন ডলার সংগ্রহ ও সরবরাহের কথা আদালতের কাছে স্বীকার করেছে তারা।

এদের মধ্যে দল নেতা মিজানুর রহমানকে পাঁচ বছর, সোহেলকে দুই বছর এবং রুবেল ও জাবাথকে ৩০ মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত ২৭ মে থেকে এই সাজা কার্যকর হবে।

দেশটির পুলিশ বলছে, সিঙ্গাপুরে গিয়েই এরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে। তবে সাজাপ্রাপ্ত চার বাংলাদেশি বৈধভাবেই সেখানে কর্মরত ছিল।

এর আগে, গত এপ্রিলে সিঙ্গাপুরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে আট বাংলাদেশিকে আটক করা হয়। পরে ছয়জনকে জঙ্গিবাদে মদদ ও অর্থায়নের অভিযোগে অভিযুক্ত করে দেশটির আদালত। তাদের মধ্যে এই চারজনকেই প্রথম সিঙ্গাপুরে জঙ্গি অর্থায়ন বিষয়ক আইনে সাজা দেওয়া হলো।

অভিযুক্ত অপর দুই বাংলাদেশি লিয়াকত আলী মামুন (২৯) ও দৌলতুজ্জামান (৩৪) আদালতে তাদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ অস্বীকার করায় দেশটির আদালতে তাদের বিচার চলমান রয়েছে।

প্রবাসী কর্মীদের জঙ্গিবাদে জড়িত হওয়ার খবর হতাশাজনক উল্লেখ করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বেনারকে বলেন, “ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে দেশে-বিদেশে তরুণদের বিপথগামী করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ রুখতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।”

তিনি বলেন, বিদেশ গিয়ে যাতে কেউ এ ধরনের ভ্রান্ত পথে যেতে না পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের সতর্ক করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী।

আইএস সম্পৃক্ততা

শুনানিতে প্রসিকিউশন আদালতকে জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ হয় মিজানুর রহমানের। তিনবার চেষ্টা করেও সে আইএস-এর সঙ্গে যুদ্ধে যেতে ব্যর্থ হয়। পরে গত মার্চ মাসে সিঙ্গাপুরে প্রবাসী কয়েকজন বাংলাদেশিকে নিয়ে মিজানুর ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ নামে একটি দল গঠন করে।

শুনানিতে আরও বলা হয়, আইএসে যোগ দিয়ে ‘মুজাহিদ’ হওয়ার স্বপ্ন দেখা মিজানুর তার দলবল নিয়ে নিয়মিত বুন লে পার্ক এবং ওয়াটার ফ্রন্ট পার্কে মিলিত হয়ে পরিকল্পনা করত। এমনকি বাংলাদেশে ফিরে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনাও ছিল তাদের। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে আইএসের স্বঘোষিত খেলাফতের অধীনে নেওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

আদালতের তথ্যানুযায়ী, জঙ্গি কর্মকাণ্ডের জন্য সংগ্রহ করা এক হাজার ৩৬০ মার্কিন ডলার ছিল জাবেদের কাছে। এর মধ্যে রুবেল সংগ্রহ করে দেয় এক হাজার ৬০ ডলার। দলের অন্য সদস্যরাও ‘জিহাদের জন্য’ ৬০ থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত চাঁদা দেয়।

গত মে মাসে আট বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তারের পর মিজানুরের কাছে বাংলাদেশের সরকার ও সামরিক কর্মকর্তাদের একটি তালিকা পাওয়ার কথা জানিয়েছিল সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যাদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেছিল মিজানুর ও তার দল।

ধর্ম শিখতে গিয়ে ভুল পথে

সিঙ্গাপুরে মাঝারি পর্যায়ের দক্ষ কর্মী মিজানুর রহমান ধর্মীয় বিষয় শিখতে গিয়ে ভুল পথে যাওয়ার কথা স্বীকার করে আদালতকে জানায়, সে যাদের কাছে ধর্মীয় শিক্ষা নিতে গিয়েছিল, তারাই তাকে ভুল পথে নিয়ে ভুল কর্মকাণ্ডে যুক্ত করেছে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রসিকিউটরকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, জঙ্গিবাদের জন্য সংগৃহীত অর্থ এই চার শ্রমিকের মজুরির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই বিচারের মাধ্যমে জঙ্গি অর্থায়নে নিয়োজিতদের প্রতি কঠোর বার্তা দেওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।

গত এপ্রিলে আরও ৫ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের সম্পর্ক তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

প্রবাসীদের ব্রিফিংয়ের পরামর্শ

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশের তরুণদের মত প্রবাসী বাংলাদেশিদেরও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত হওয়া ঠেকাতে সরকারকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশ যাওয়ার আগে থেকে সেখানে কর্মরত অবস্থায় তাঁদের নিয়মিত ব্রিফিং করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংগঠন দৃষ্টি রিসার্চ সেন্টারের সিনিয়র গবেষক হান্নান বিশ্বাস বেনারকে বলেন, “ধর্ম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা পাওয়ার কারণে অনেকেই জিহাদি হয়ে উঠছেন। দেশ ত্যাগের পূর্বে বিদেশ যাওয়া শ্রমিকদের গন্তব্য দেশের পরিবেশ, সংস্কৃতি ও আইন সম্পর্কে ব্রিফিংয়ের পাশাপাশি জঙ্গিবাদ বিষয়ে ধারণা দিতে হবে।

তাঁর মতে, দূতাবাসের মাধ্যমে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে নিয়মিত জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, এটা করলে নিজ দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।