নিরীহ শিক্ষক ঘরছাড়া; সাংসদ সেলিম হুঙ্কার দিয়েই যাচ্ছেন
2016.05.26

দেশের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী সাংসদ এ কে এম সেলিম ওসমানকে তাঁর কৃতকর্মের জন্য নিরীহ শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চাওয়ার অনুরোধ করছেন। জবাবে বারবারই ওই সাংসদ বলছেন, তিনি ক্ষমা চাইবেন না।
গতকাল বৃহস্পতিবারও সেলিম ওসমান মত বিনিময় সভা ডেকে জানিয়ে দেন তিনি ক্ষমা চাইবেন না। উল্টো তিনি ওই শিক্ষককে ‘নাস্তিক’ বলে আখ্যা দেন, ‘চাঁদাবাজ’ বলে অভিহিত করেন।
গত ১৩ মে বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে মারধর করে স্থানীয় একদল লোক। পরে তাকে কান ধরিয়ে উঠ-বস করান সাংসদ সেলিম ওসমান।
এরপর থেকে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেন ফুঁসে উঠেছে গোটা নারায়ণগঞ্জ। সাংসদের হুঙ্কার চলছে। বাম সংগঠন ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন বিতর্কিত ওই সাংসদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।
হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী গতকালই শিক্ষা মন্ত্রণালয় অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে চাপের মুখে ওই প্রধান শিক্ষক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ওই শিক্ষককে চাকিরচ্যুত করা হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাঁকে পুনর্বহালের উদ্যোগ নেয়। তবে ঘটনার পর থেকে এলাকাছাড়া ওই প্রধান শিক্ষক। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
“আমি একজন নিরীহ শিক্ষক। তবে আমার পাশে দেশের লাখ লাখ মানু ষকে পেয়েছি। এ জন্য তাঁদের ধন্যবাদ। কিন্তু আমার মতো র্দুবল শিক্ষকের পক্ষে ওই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়। এটাই বাস্তবতা,” টেলিফোনে বেনারকে জানান শ্যামল কান্তি।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি মামলা করতে চাই না। মামলা করে কী হবে? কে, কতোদিন আমার নিরাপত্তা দেবে?”
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ওই সাংসদ অপরাধ করেছেন। কিন্তু ভুক্তভোগীকে প্রতিকার চাইতে হলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে।
সেলিম ওসমানের মত বিনিময়
গতকাল মত বিনিময় সভা ডাকলেও সেলিম ওসমান সাংবাদিকদের প্রশ্ন নেননি। একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করতে চাইলে সেলিম ওসমান বলেন, “খোচাখুঁচি না করাই ভালো।”
ওই সভায় নারায়ণগঞ্জ ওলামা পরিষদ ও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা ছাড়াও কয়েকজন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক নেতা, ও আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সেলিম ওসমান বলেন, “শ্যামল কান্তি ভক্তকে হিন্দু হিসেবে নয়, নাস্তিক হিসেবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।”
“জনতার রোষ থেকে শ্যামল কান্তিকে প্রাণে রক্ষা করার জন্য কান ধরিয়ে উঠ-বস করানো ছাড়া উপায় ছিল না,” বলেন ওই সাংসদ।
তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে
নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক অবমাননার এই ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি করে।
গতকাল আদালতে দেওয়া ওই কমিটির প্রতিবেদনে কমিটি বলছে, বিদ্যালয়টির পরিচালনা পরিষদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের বিরোধের জের ধরে তাঁর বিরুদ্ধে একটি পক্ষ ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে স্থানীয়দের প্ররোচিত করে।
শিক্ষকের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির যে অভিযোগ এক শিক্ষার্থীকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছিল, ওই ছাত্রের বক্তব্য অসংলগ্ন বলে তদন্ত কমিটির কাছে মনে হয়েছে।
উচ্চ আদালত ওই ঘটনায় স্বতঃপ্রনোদিত হয়ে রুল দিয়েছিলেন। ওই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা গত ১৮ মে জানতে চান আদালত।
আদালতের সেই আদেশে বলা হয়, “ওই অমানবিক ও নিগ্রহজনক ঘটনা আমাদের বিচারিক বিবেকে নাড়া দিয়েছে। সংবিধানের অভিভাবক সুপ্রিম কোর্ট। অভিভাবক হিসেবে আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।”
আগামী ২৯ মে বিষয়টি আবারও আদালতের কার্যতালিকায় আসবে বলে জানান আদালত।
গতকাল তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে জমা দেয়।
“রোববার প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দেওয়া হবে। এরপর আদালত সিদ্ধান্ত জানাবেন,” বেনারকে বলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু।
কে এই সেলিম ওসমান?
ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সন্তান। তার দাদা খান সাহেব ওসমান আলী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন পৃষ্ঠপোষকদের একজন। সেলিমের বাবা এ কে এম শামসুজ্জোহা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।
সেলিমের ছোট ভাই এ কে এম শামীম ওসমান বর্তমানে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য। তাদের বড় ভাই নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর মৃত্যু হলে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য হন সেলিম।
শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনার পর ক্ষমতাসীর দলের কমপক্ষে পাঁচজন মন্ত্রী ও বেশ কয়েকজন নেতা সেলিম ওসমানের কর্মকান্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা অন্য দলের হলেও সেলিম ওসমানের পক্ষ নিয়েছেন। এমনকি বিরোধী দল বিএনপি, ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনও সেলিম ওসমানের পক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
সেখানে একটি পরিবারের কাছেই রাজনীতি ও ব্যবসা–বাণিজ্য জিম্মি হয়ে পড়েছে। ওই পরিবারের একজন ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় তাঁর উত্তরাধিকারেরা যাচ্ছেতাই করছেন বলে মত দিয়েছেন অনেকেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “যেখানে সরকারই তাকে প্রশয় দেয়, সেখানে কার, কী করার আছে? এখানে কাউকে রাজনীতি বা ব্যবসা–বাণিজ্য করতে চাইলে ওসমান পরিবারের সঙ্গেই থাকতে হবে।”