প্রভাবশালীদের হাতে গৃহশ্রমিক নির্যাতন বাড়ছেই

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.04.06
workers-620.jpg গৃহশ্রমিক জান্নাত আক্তার শিল্পীর মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত এবং অব্যাহত গৃহশ্রমিক নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাবেশ করে গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্ক। ২৯ মার্চ ২০১৬।
বেনার নিউজ

বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের হার বাড়ছে। অসহায় দরিদ্র মানুষগুলো পেটের দায়ে বাসাবাড়িতে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছেন সম্পদশালীদের কাছে।

সম্প্রতি দেশের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধেও উঠেছে গৃহশ্রমিক নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর সারা দেশে বিভিন্ন ঘটনায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৩জন গৃহকর্মী। এঁদের মধ্যে নিহত হয়েছেন ৩২ জন।

তবে নির্যাতনের ঘটনাগুলোর তুলনায় মামলা দায়েরের সংখ্যা বেশ কম। আসক জানায়, গত বছর ৬৩টি নির্যাতনের ঘটনার মধ্যে মামলা রেকর্ড হয়েছে মাত্র ২২টি।

গৃহশ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় আইন না থাকা এবং সম্পদশালীদের প্রভাবে নির্যাতিতদের দরিদ্র পরিবারের মামলা চালাতে অনীহাই এর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

সাম্প্রতিক আলোচিত ঘটনা

গত ২৩ মার্চ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কণ্ঠশিল্পী কৃষ্ণকলির বাসায় সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তার গৃহকর্মী জান্নাতুল আক্তার শিল্পীকে। দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান কৃষ্ণকলির স্বামী খালেকুর রহমান অর্ক। চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মুখে আঁচড়ের দাগ দেখে সেদিনই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার করা হন অর্ক। শিল্পী আত্মহত্যা করেছে এমন দাবির মুখেও তাকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

তবে গত বৃহস্পতিবার শিল্পীর ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যার আলামত মেলার পর পুলিশের উপস্থিতিতে দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়। এরপরেই কৃষ্ণকলির স্বামী নির্দোষ ঘোষণা আসে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা।

এ বিষয়ে রাজধানীর শেরে বাংলা নগর থানার তদন্ত কর্মকর্তা সুশীল চন্দ্র বর্মণ জানান, “ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্পীর মৃত্যু হয়েছে ‘হ্যাঙ্গিংয়ে’। তার শরীরে ধর্ষণের কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি।”

নিহতের বড় বোন রেনু আক্তার বেনারকে বলেন, “গত বৃহস্পতিবার শেরেবাংলা থানার পুলিশ আমাদের জানায়, আমার ছোট বোন শিল্পী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সেখানেই আমাদের সঙ্গে কৃষ্ণকলির পরিবারের আপস-মীমাংসা হয়। আসলে মামলা করলেও তো বোনকে আর ফেরত পাব না। তাই আমার বোন মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না –বলে একটা কাগজে লিখে দিয়েছি।”

রেনু জানান, ময়না তদন্ত শেষে শিল্পীর লাশ দাফনের জন্য বাড়িতে নিতে ১০ হাজার টাকা দেয় কৃষ্ণকলির পরিবার। এরপর আপসের সময় আর কোন টাকা দেওয়ার কোনো প্রসঙ্গ আসেনি।

তবে এ ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রভাব খাটিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার অভিযোগও শিল্পী পরিবারে বিরুদ্ধে। আরও নানা প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায়নি।

এ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, “প্রথম থেকেই প্রভাবশালী মহলের মাধ্যমে নির্যাতিত গৃহকর্মী শিল্পীর পরিবারকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হচ্ছিল। এখন সেটা স্পষ্ট। আপসের ঘটনা বলে দেয়, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘সঠিক তথ্য’ নেই।”

ডা. ইমরান বলেন, “শেষ মেষ প্রভাবশালীদেরই জয় হলো। ন্যায় বিচার বঞ্চিত হল শিল্পী ও তার পরিবার। আমরা চাই, শিল্পীর ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত হোক। দোষীরা শাস্তি পাক।”

শরিফ এ কাফি নামে এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, “পুলিশ শুরুতেই এ ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা করেছিল। এখন ময়না তদন্ত রিপোর্টেও ফাঁসে মৃত্যু বলা হচ্ছে। ঘোষণা আসছে, সন্দেহভাজনরা সব "নির্দোষ"। …এখন শিল্পীর পরিবার এ ঘটনায় থানা বা আদালতে আর কোন মামলা করবে না- মর্মে আপসনামা হয়েছে কৃষ্ণকলি এবং গৃহকর্মী  শিল্পীর পরিবারের মধ্যে।  এ রকম আপসনামা কেন করতে হল?

তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, পৃথিবীর সকল দেশেই আপসনামার মাধ্যমে মামলা "মিটমাট" হয়। বাংলাদেশে ফৌজদারি বা ক্রিমিনাল কেসে আদালতের বাইরে আপস গ্রহণ যোগ্য নয়, বেআইনি। তারপরও পুলিশ ও আদালত তা গ্রহণ করে।

গত বছরের অক্টোবর থেকে গৃহশ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় কারাগারে আছেন জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহান ওরফে নৃত্য শাহাদাত। তাদের বাসার গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার ওরফে হ্যাপিকে (১১) অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর কালশীর এলাকা থেকে উদ্ধার করে তাদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা খন্দকার মোজাম্মেল হক নামে এক ব্যক্তি।

ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেনের বাসায় সাত মাস আগে কাজে যোগ দেওয়া হ্যাপিকে শাহাদাত ও তাঁর স্ত্রী প্রায়ই মারধর করতেন, গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিতেন বলে ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়। হ্যাপিও পুলিশের কাছে একই অভিযোগ করে জানায়, একদিন দরজা খোলা পেয়ে অসুস্থ অবস্থায় বাসা থেকে পালিয়ে আসে সে।

এক বছরে নিহত ৩২ গৃহকর্মী

বেসরকারি সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্র (আসক) বলছে, গত ২০১৫ সালে সারা দেশে ৬৩জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ধর্ষণ ও অন্যান্য নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ৩২ জন।

আসকের জরিপে দেখা যায়, নির্যাতিত গৃহশ্রমিকদের বেশিরভাগেরই বয়স ৭-১৮ বছরের মধ্যে। নিহতদের ২৩ জনের বয়স ১৮ বা তার নিচে। ১৩জনের বয়স ৭-১২ বছরের মধ্যে। আর এসব ঘটনায় মামলার সংখ্যা অর্ধেকেরও কম।

নীতিমালা আছে, প্রয়োগ নেইপ্রয়োজন আইন

দীর্ঘদিনের দাবি পর গত বছরের শেষে গৃহশ্রমিকের সুরক্ষায় নতুন নীতিমালা চূড়ান্ত করে সরকার। তবে এ বিষয়ক কোন আইন না থাকায় এ নীতিমালা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ গৃহশ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে আন্দোলনকারীদের। তাই অতি সত্ত্বর গৃহ শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় আইন করার দাবি জানান তারা।

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বেনারকে বলেন, “দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে সরকার গৃহশ্রমিক নীতিমালা করলেও আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায়, সে নীতিমালার বাস্তবায়ন নেই। তাই গৃহশ্রমিকদের নিরাপত্তা সুরক্ষা ও অধিকার আদায়ে আইন প্রণয়ন করা জরুরি। তবে সেদিনই সমাজে গৃহশ্রমিক নির্যাতন কমবে, যেদিন দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে।”

প্রবীণ ওই শ্রমিক নেতা বলেন, নির্যাতিত গৃহশ্রমিকেরা সমাজের দুর্বল শ্রেণি। তারা মামলা করলেও অনেক সময় প্রভাবশালীদের চাপে তা তুলে নিতে বাধ্য হয়। আবার মামলা পরিচালনার সামর্থ্য তাদের থাকে না। তাই সরকারকে নিজ দায়িত্বে এসব মামলা দায়ের ও পরিচালনা দায়িত্ব নিতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।