ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিবকে হত্যার হুমকিদাতা গ্রেপ্তার
2020.11.17
ঢাকা

কলকাতায় গিয়ে কালীপূজা উদ্বোধনের সংবাদ ‘সঠিক নয়’ তারপরও কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন ক্রিকেটের অন্যতম বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান।
এদিকে পূজায় যাওয়ার জন্য সাকিবকে হত্যার হুমকিদাতা মহসীন সরকারকে (২৫) মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
“দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের রণসী গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন মহসীন। মঙ্গলবার সকালে আমরা তাঁকে গ্রেপ্তার করি,” বেনারকে বলেন সুনামগঞ্জ র্যাবের ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানি (সিপিসি)-৩ এর অধিনায়ক লে. কমান্ডার ফয়সল আহমদ।
সাকিব পূজার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে মহসীন এই কাজ করার কথা র্যাবকে জানিয়েছেন বলে জানান ফয়সল।
এদিকে হুমকিদাতাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করায় সন্তোষ প্রকাশ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বেনারকে বলেন, “মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এ ধরনের হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।”
সাকিব সম্প্রতি ভারতে একটি পূজার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন মর্মে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর শনিবার থেকে বহু মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন।
রোববার দিবাগত রাত ১২টা ৭ মিনিটে মহসীন তালুকদার নামের ওই ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে এসে দা উঁচিয়ে সাকিবকে হত্যার হুমকি দেন। মহসীন সিলেটের সদর উপজেলার টুকেরবাজার শাহপুর তালুকদার পাড়ার বাসিন্দা।
পূজায় যোগ দেওয়ার দায়ে অশ্লীল গালিগালাজের পাশাপাশি সাকিবকে পেলে কুপিয়ে হত্যার হুমকি দেন মহসীন।
তবে এর পরে ভোর ৬টার দিকে অন্য একটি লাইভ ভিডিওতে রাতের উত্তেজিত ভিডিওর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সাকিব আল হাসানকে জাতির উদ্দেশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান মহসীন।
হুমকির ঘটনায় জালালাবাদ থানার এসআই মাহবুব মুর্শেদ সোমবার রাতে মহসীনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। এরপর মহসীনকে ধরার জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
সাকিবের ক্ষমা প্রার্থনা
এই বাস্তবতায় নিজের ইউটিউব চ্যানেল থেকে এক ভিডিও বার্তায় দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন সাকিব। কলকাতায় গিয়ে কালীপূজা উদ্বোধন সংক্রান্ত খবরটি অস্বীকার করেছেন তিনি।
“আমি নিজেকে একজন গর্বিত মুসলমান হিসেবে মনে করি এবং সেটাই পালন করার চেষ্টা করি,” জানিয়ে ভিডিও বার্তায় সাকিব বলেন, “আমার কোনো ভুল হয়ে থাকলে অবশ্যই আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনাদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে সেজন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
তিনি অনুষ্ঠানস্থলে যাবার আগেই “পূজার উদ্বোধন” হয়ে গিয়েছিল জানিয়ে সাকিব বলেন, “পূজার উদ্বোধন আমি কখনোই করিনি এবং সচেতন মুসলমান হিসেবে আমি করব না।”
“তারপরও হয়তো ওখানে যাওয়াটাই আমার ঠিক হয়নি। সেটা যদি আপনারা মনে করে থাকেন, তাহলে আমি অবশ্যই আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটির চেষ্টা করব।”
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) র্যাংকিংএ বাংলাদেশি সাকিব আল হাসান বর্তমানে এক দিনের ক্রিকেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।
বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো ক্রিকেটার হিসেবে ২০১৫ সালে সাকিব ছিলেন একই সাথে টেস্ট, ওয়ানডে ডে ও টি-২০ ক্রিকেটে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।
‘ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার হচ্ছে’
পূজার অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সাকিবকে হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনাকে দেশে মৌলবাদী উত্থানের সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ মাহমুদ বেনারকে বলেন, “সাকিবের ক্ষমা চাওয়া ছাড়া কী উপায় ছিল? তাঁকে তো বাঁচতে হবে। কেউ তো তাঁকে বাঁচাতে আসবে না।”
“সাকিব আল হাসানকে হুমকি দেওয়াটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়,” মন্তব্য করে ইমতিয়াজ বলেন, “প্রশ্রয় দিতে দিতে সাম্প্রদায়িকতা এখন চূড়ান্তরূপ লাভ করেছে।”
তিনি বলেন, “একটি সহনশীল সমাজে যার যার মতো করে ধর্ম পালন করা হয়। কিন্তু একটি সাম্প্রদায়িক সমাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা মেজরিটি, আমাদের বিশ্বাসের বাইরে কেউ কিছু করবে না। যারা করবে তাদের হুমকি দেওয়া হবে, চাপে রাখা হবে।”
“সাকিব ক্ষমা চেয়েছে খুনের ভয়ে। এভাবে সব লোককে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করার চেষ্টাটা অশনি সংকেত,” বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুর রশিদ।
তাঁর মতে, “এতে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার লোক কমে যায়। সেটি জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।”
“এটা ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহার। ব্যক্তি স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করার উদ্দেশ্য এসব করা হচ্ছে। সাকিবকে পরাজিত করতে পারলে অন্যরাও সাহস হারাবে,” বলেন জেনারেল রশীদ।
তিনি বলেন, “আগে ধর্মীয় সম্প্রীতি এমন ছিল যে, আমরা সবাই যার যার ধর্ম পালন করতাম কিন্তু সবাই একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম, এখনও দেই। এ জন্যই কথাটি এসেছে, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। বিরাজমান সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্য ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করা হচ্ছে।”
“পূজার অনুষ্ঠান উদ্বোধন করাটা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু সাকিব যেহেতু ক্ষমা চেয়েছেন এবং বলেছেন তিনি উদ্বোধন করেননি, তাই এই বিষয়টি নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করা উচিত হবে না,” বলে মন্তব্য করেন তুলনামূলকভাবে উদারপন্থী ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ।
কিন্তু পূজায় যাওয়ার জন্য একজন মানুষকে কেন ক্ষমা চাইতে হবে; এই প্রশ্নের জবাবে মাওলানা মাসুদ বেনারকে বলেন, “দেশের মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে বুঝতে হবে, এজন্য সবার সতর্ক থাকা উচিত।”
এদিকে সমাজে প্রবল সাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ খুব বেশি নয় বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
“একজন বা দু’জন মানুষের কার্যক্রম দেখে পুরো বাংলাদেশকে বিবেচনা করা ঠিক হবে না,” জানিয়ে তিনি বেনারকে বলেন “আমরা পূজায় সবাই যাচ্ছি। সকল ধর্মের মানুষ একে অপরের উৎসবে যাচ্ছে।”
সাম্প্রদায়িকতাকে সংক্রামক রোগের সাথে তুলনা করে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “একজন মৌলবাদী লোক বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে তা অনেকের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এগুলো যাতে বাড়তে না পারে সে জন্য আমাদের সবার সতর্কতা দরকার।”