রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক বিরোধী প্রচার শুরু করেছে পুলিশ
2019.05.09
ঢাকা ও কক্সবাজার
ইয়াবা বেচাকেনা, বহন ও সেবন থেকে রোহিঙ্গাদের বিরত রাখতে শরণার্থী শিবিরগুলোতে মাদক বিরোধী প্রচারণা শুরু করেছে পুলিশ। তবে বিশ্লেষকদের মতে এ ধরনের প্রচারণা সারা দেশে না চালালে ইতিবাচক ফল আসার সম্ভাবনা কম, কারণ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই রোহিঙ্গাদের মাদক ব্যবসার কাজে লাগাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সপ্তাহব্যাপী এই প্রচারণা শুরু হয় বলে বেনারকে জানান টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস।
তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অভিযান পরিচালনার পর থেকে স্থানীয়দের ইয়াবা ব্যবসা অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু সম্প্রতি রোহিঙ্গারা ‘পেটের ভেতর’ করে ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ছে।”
“রোহিঙ্গাদের মাদক থেকে দূরে রাখতে ক্যাম্পে ক্যাম্পে মাদক বিরোধী সভা পরিচালনা করছে সরকার। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মাদক ব্যবসা, সেবন ও চোরাচালনসহ বিভিন্ন অপরাধ রোধে সচেতন করা হচ্ছে,” বলেন প্রদীপ কুমার দাস।
মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গাদের তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতার অনুরোধও জানানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নয়, এ ধরনের প্রচারণা সারা দেশে চালাতে হবে। অন্যথায় ইতিবাচক ফল আসবে না।
দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাই রোহিঙ্গাদের কাজে লাগিয়েছে মাদক বা ইয়াবার বাহক হিসেবে। তারা বহন করে আর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশিরাই। সুতরাং শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রচারণা করে ইয়াবা ব্যবসা বা ইয়াবা সেবন বন্ধ করা সম্ভব নয়।”
“এ ধরনের মাদক বিরোধী প্রচার প্রচারণা সারা দেশে করতে হবে। এর সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। অন্যথায় ফল আসবে না,” মনে করেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, গত দুই মাসে ৫০ জনের বেশি রোহিঙ্গা গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে র্যাব সাতজন, পুলিশ ১৩ জন বিজিবি ১২ জন আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগ ৮ জন রোহিঙ্গাকে ইয়াবাসহ আটক করে। এদের বেশির ভাগই অভিনব উপায়ে ‘পেটের মধ্যে’ ইয়াবা বহন করছিলো।
বৃহস্পতিবার দুপুরেও কক্সবাজারের উখিয়া থেকে আমান উল্লাহ (২৮) নামে এক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১১। এ সময় তার কাছ থেকে ২০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয় বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান।
জানা যায়, গত এক বছরে ইয়াবা বহন, সেবন ও কেনাবেচার অভিযোগে একশ’টি মামলায় দেড় শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। যার মধ্যে অর্ধেকই ‘পেটের ভেতর’ করে ইয়াবা পাচার করছিল। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র ও ছুরিসহ আরও ২০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়।
অভিনব পদ্ধতিতে ইয়াবা বহন
কক্সবাজারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সহকারী পরিচালক সোমেন মণ্ডল বেনারকে বলেন, “হঠাৎ করে একটি চক্র ‘পেটের ভেতরে’ করে ইয়াবা বহন করাচ্ছে। আর অভিনব এই পদ্ধতির বাহক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।”
তিনি জানান, “গত এক বছরে কক্সবাজারে ৪০ জনের মতো রোহিঙ্গাকে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার অপরাধে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৭টি মাদক মামলা দায়ের করা হয়।”
সোমেন মণ্ডল জানান, সর্বশেষ গত মাসের শেষের দিকে মিয়ানমার থেকে আসার সময় ২৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। এক্স-রের মাধ্যমে আটক ১৩ রোহিঙ্গার পেটে ইয়াবার অস্তিত্ব মেলে। তাদের একেক জনের পেটে তিন হাজার পিসেরও বেশি ইয়াবা পাওয়া যায়। এর বিনিময়ে রোহিঙ্গারা প্রত্যেকে ২০ হাজার টাকা করে পায় বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো পলিথিনে জড়িয়ে কলা বা অন্য কিছুর সাথে খেয়ে ফেলে বাহকেরা। পরে মলের সাথে সেগুলো বেরিয়ে আসলে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। পেটের মধ্যে করে নিয়েই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে যায় তারা।
টেকনাফের লেদা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বেনারকে বলেন, “হঠাৎ করে পেটের ভেতর করে ইয়াবা বহনকারী রোহিঙ্গারা ধরা পড়ছে বেশি। এমন করে ইয়াবা বহনকালে সব মিলিয়ে ২০ জনের বেশি আমার ক্যাম্প থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে।”
এভাবে পেটের মধ্যে করে ইয়াবা বহন অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে মৃত্যুরও ঝুঁকি আছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সহকারী পরিচালক সোমেন মন্ডল।
“পুলিশ বিভিন্ন ক্যাম্পে মাদক বিরোধী সভা করছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের সচেতন করা হচ্ছে। বিষয়টি ইতিবাচক। আশা করি রোহিঙ্গারা এ বিষয়ে আরও সচেতন হবে,” বলেন মোহাম্মদ আলম।
শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান রমিদা বেগমের (২৮) মতে, “অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় কিছু লোক রোহিঙ্গাদের এ কাজে জড়াচ্ছে। পরিবারের অভাব দূর করতে তারাও ঝুঁকি নিয়ে এসব কাজে লিপ্ত হচ্ছে।”
তৎপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের জানান, তাঁর এলাকা থেকে গত ১০ মাসে মাদক বহনকালে ৩০ জনের বেশি রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে।
তিনি বেনারকে বলেন, “অসহায়ত্ব ও অভাবের সুযোগ নিয়ে কিছু লোক রোহিঙ্গাদের মাদক ব্যবসায় জড়াচ্ছে। দেশীয় মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে এসব ক্যাম্পে বসবাস করা পুরাতন রোহিঙ্গারাও এর সাথে জড়িত।”
র্যাব-১৫ এর টেকনাফ ক্যাম্পের ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট মির্জা শাহেদ মাহতাব বেনারকে বলেন, “আমরা গত ১০ মাসে মাদকসহ ৫১ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছি। তাদের কাছ থেকে ৪ লাখের বেশি ইয়াবা উদ্ধার করেছি। এ ঘটনায় মাদক আইনে থানায় ৩৫টি মামলা রুজু করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “র্যাবের মাদক বিরোধী অভিযানে অনেক ইয়াবা পাচারকারীও রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। যে কারণে শিবিরগুলোয় আমাদের তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে।”
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যে ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।”