রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার প্রকাশ্য কর্মসূচি, ‘হ্যাপি ডে’, গ্রেপ্তার ২
2022.10.11
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজারের একাধিক শরণার্থী শিবিরে রোববার আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ঘোষিত ‘হ্যাপি ডে’ (খুশির দিন) কর্মসূচি আয়োজনের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর তৎপর হয়েছে পুলিশ। ক্যাম্প এলাকায় প্রথমবারের মতো আরসার এই প্রকাশ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নে জড়িত দুইজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
উখিয়ার বালুখালীর ১০ নম্বর শিবির থেকে রোববার মোহাম্মদ জয়নাল (৩২) এবং সোমবার বক্কর উদ্দিন আহমদ (১৯) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ।
জয়নাল “সরাসরি পোস্টার লাগানো ও অপপ্রচার চালানোর সঙ্গে জড়িত ছিল,” জানিয়ে তিনি বলেন, “তার কাছ থেকে আমরা আরো কয়েকজন জড়িত ব্যক্তির নাম পেয়েছি। তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করার পর এই ষড়যন্ত্রে কারা যুক্ত আছে, তা জানা যাবে।”
“দুষ্কৃতিকারী সংগঠনটি যেভাবে কথিত হ্যাপি ডে উদযাপনের ভিডিওগুলো ছড়িয়েছে এবং ক্যাম্প এলাকায় পোস্টার লাগিয়েছে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি আমরা,” যোগ করেন ৮-এপিবিএনের কর্মকর্তা ফারুক।
বিতর্কিত ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বর্মী সেনাদের বিরুদ্ধে কথিত ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’ শুরুর ছয় বছর পূর্তি উদযাপন করেছে।
তাদের নিয়ন্ত্রিত টুইটার, ফেসবুক পেইজ, মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপের মতো বার্তা আদানপ্রদানকারী এ্যাপসগুলোতে বিভিন্ন শিবিরে কেক কেটে বা মিছিল ও মানববন্ধন করে দিনটি উদযাপনের ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, রাখাইনে ২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালে গঠিত হয় হারাকাহ আল-ইয়াকিন (বিশ্বাসের আন্দোলন) নামের রোহিঙ্গা সংগঠন। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বর্মী বর্ডার পোস্টগুলোতে আক্রমণের মাধ্যমে সশস্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আরসা। তখন আরসা পরিচয় দিয়ে ঘটনার দায় স্বীকার করেছিল তারা।
ছবি-ভিডিওগুলোতে যা আছে
ভাইরাল হওয়া ছবি-ভিডিওগুলোতে হ্যাপি ডে উদযাপনকারীদের আরসার লোগো এবং তাদের প্রধান নেতা আতাউল্লাহ আবু আমার জুনুনীর ছবিযুক্ত টি শার্ট, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও ব্যানার ব্যবহার করা হয়।
“আজ ৯ অক্টোবর, আমাদের জন্য কীসের দিন? —খুশির দিন,” এভাবেই খোলা জায়গায় জমায়েতের একটি ভিডিওতে তাঁদের স্লোগান দিতে দেখা যায়।
“এটি সেই দিন, যেদিন আরসা বার্মার জালিম সরকারের লোকদের হামলা করে রোহিঙ্গা জাতিকে জুলুম থেকে ন্যায় পাওয়ার পথে নিয়ে এসেছে। সেই খুশিতে আজ বাংলাদেশের রিফিউজি ক্যাম্পে আমরা কেক কেটে আনন্দ উদযাপন করব,” বদ্ধ ঘরের এক ভিডিওতে তাঁদের বলতে শোনা যায়।
আরসা-বিরোধীদের ভাষ্য
রোহিঙ্গা নেতাদের মতে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঠেকাতেই এখানে আরসা এভাবে প্রকাশ্যে এসেছে।
নিরাপত্তার কারণে প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়ার এক রোহিঙ্গা নেতা সোমবার বেনারকে বলেন, “তারা (আরসা) ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গাদের হুমকি দিয়ে জড়ো করে। তারা যদি না যায় তবে তাদের জবাই করার ভয় দেখানো হয়।”
“আসল কথা হচ্ছে আরসা বর্মী সরকারের গোলাম। রোহিঙ্গারা যাতে নিজেদের ভূমিতে ফিরতে না পারে, সে লক্ষ্যেই তারা এমনটা করেছে,” বলেন ওই রোহিঙ্গা নেতা।
তবে পুলিশ কর্মকর্তা ফারুক আহমেদের মতে, হ্যাপি ডে উদযাপনকারীদের শনাক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরই পুলিশ নিশ্চিত হতে পারবে তাদের জোরপূর্বক নেওয়া হয়েছিল কিনা।
গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পঞ্চমবার্ষিকী উদযাপনকালে প্রত্যাবাসনের দাবি তোলার চার দিনের মাথায় ক্যাম্পের আরসা-বিরোধী দুই রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যার হুমকি দিয়ে ‘রোহিঙ্গা জি নিউজ’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছিল।
তাঁদের একজন গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার হামলায় নিহত মুহিব উল্লাহর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) নেতা মোহাম্মেদ জুবায়ের।
আরসা প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তাপ্রদানকারী এ্যাপের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের পক্ষে সক্রিয় রোহিঙ্গাদের হত্যার হুমকি দেয় বলে বেনারকে জানান জুবায়ের।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
ভূ রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিষয়ক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদের ধারণা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকার এবং আরাকান আর্মির (এএ) সাম্প্রতিক অবস্থানের কারণে আরসা ক্যাম্প এলাকায় ‘শোডাউন’ করেছে।
গত আগস্ট থেকে রাখাইন ঘেঁষা বাংলাদেশ সীমান্তে দফায় দফায় মর্টার হামলা হওয়ার জন্য এএ এবং আরসার ওপর দায় চাপিয়ে ২০ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক উ জাউ ফিউ উইন দাবি করেন, বাংলাদেশে ওই সংগঠনগুলোর ঘাঁটি রয়েছে।
এ ব্যাপারে ৬ অক্টোবর ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “সেখানে (রাখাইনে) এখন যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, সেটা একদমই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সেখানে আমরা নাক গলাতে যাইনি, যাবও না। এমনকি অন্য দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা বিদ্রোহ চালানোর জন্য আমাদের মাটি কেউ ব্যবহার করতে পারবে না।”
এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর এএ-র রাজনৈতিক উইং ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকানের (ইউএলএ) মুখপাত্র খাইং থুখার এক অনলাইন প্রেস কনফারেন্সে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের সাথে আলোচনা করতে হবে।
“মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে (রাখাইন রাজ্যে) এই সময়ে এএ-র জয়জয়কার চলছে,” জানিয়ে জেনারেল রশিদ বেনারকে বলেন, “তাদের পাশে আরসার সাংগঠনিক অস্তিত্বই এখন বিলীন প্রায়।”
“আরসা মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তাদের সক্রিয়তা জানান দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে নেই বলেই ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রচারণাসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে,” যোগ করেন গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের এই নির্বাহী পরিচালক।
অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীরের মতে, “বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকার আরসার অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও আমাদের বিশ্বাস, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর কাছে এই তথ্য ছিল যে, ক্যাম্পে অবস্থানকারী সশস্ত্র ব্যক্তিদের সাথে আরসার কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ রয়েছে। যা এখন আরো প্রত্যক্ষ হচ্ছে।”
“এতে ক্যাম্পের সাধারণ রোহিঙ্গাদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। তাদের আশ্বস্ত করার জন্য সেখানে সরকারের জোরদার পদক্ষেপ দরকার,” বেনারকে বলেন মুনীর।
তাঁর মতে, “প্রয়োজনে সামরিক গোয়েন্দাদের সহায়তায় কিছু স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা দরকার। তা না হলে এমন ঘটনা আরো ঘটতে পারে।”
এদিকে প্রয়োজনে শরণার্থী শিবিরের ভেতরে-বাইরে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী কাজ করবে বলে গত ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।