অবশেষে ভাসানচরে যেতে রাজি সাড়ে তিনশ রোহিঙ্গা পরিবার

কামরান রেজা চৌধুরী ও সুনীল বড়ুয়া
2019.10.21
ঢাকা ও কক্সবাজার
অবশেষে ভাসানচর যেতে রাজি  সাড়ে তিনশ রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরের একটি দৃশ্য। ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৮
ছবি: রয়টার্স

প্রথমবারের মতো নোয়াখালীর ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী। সরকারের কয়েক দফা চেষ্টার পর সম্প্রতি ৩৫০ টি রোহিঙ্গা পরিবার বঙ্গোপসাগরের কাছে অবস্থিত ওই দ্বীপে বসবাস করতে রাজি হয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ওই ৩৫০ রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।”

একাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী জানান, ভাসানচরে নির্মিত ঘরবাড়ি নিয়ে তৈরী ভিডিও তারা দেখেছেন। সেগুলো উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পের চেয়ে ভালো। আর সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকবে, যা কক্সবাজারে নেই।

জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে হলে তা অবশ্যই স্বেচ্ছাধীন হতে হবে। আর সেখানকার পরিবেশ সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য তাদের দিতে হবে।

প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের ভাসানচর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছি। ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি। ইতিমধ্যে ৩৫০টি রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচর যেতে রাজি হয়েছে।”

তিনি বলেন, “যদি সব ঠিকঠাক থাকে তাহলে পরিকল্পনা অনুযায়ী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আমরা প্রথম ব্যাচে ওই পরিবারগুলোকে ভাসানচর স্থানান্তর করবো।”

স্থানান্তরের অংশ হিসাবে ১৬ অক্টোবর থেকে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে ভাসানচরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক তালিকা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহাবুব আলম তালুকদার।

তিনি বেনারকে বলেন, “রাখাইনে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে রোহিঙ্গাদের অনীহা থাকলেও ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি খুবই ইতিবাচক।”

মাহাবুব তালুকদার বলেন, “সরকার আপাতত এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসান চরে পাঠাতে চায়। সেই লক্ষ্যকে ধরেই কাজ চলছে।”

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী বেনারকে জানান, “বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা স্থানীয়দের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা যদি এখান থেকে সরানো যায় তাহলে অন্তত কিছুটা চাপ কমবে।”

টেকনাফ জাদিমুরা শালবন শরণার্থীশিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ মো. খালেদ হোসেন বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে এবার রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। শুধু টেকনাফ জাদিমুরার ৩০ পরিবার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।”

তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা রোহিঙ্গাদের কাছে ভাসানচরে কী কী সুবিধা আছে তা জানাচ্ছি। এর আগে বৈঠক করে মাঝিদের আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছি। এখন মাঝিরাও সাধারণ রোহিঙ্গাদের বোঝাচ্ছে। সবকিছু শুনে অনেকেই ভাসানচরে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।”

উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প-৩ এর বাসিন্দা ফাতেমা বেগম (২৩) বেনারকে বলেন, “এখানকার ঘরগুলো ছোট ছোট। আমরা মানুষ আছি চারজন। এখানে থাকতে সমস্যা হচ্ছে। ভিডিওতে দেখে ভাসানচর জায়গাটি আমার পছন্দ হয়েছে। তাই আমরা স্বেচ্ছায় সেখানে চলে যাচ্ছি।”

আরেক বাসিন্দা মো.আলম (২৫) বেনারকে বলেন, “জায়গাটি দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ঘরবাড়িগুলোও বড় বড়।”

তিনি বলেন, “এখানে খুব গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। এখানে কোন কাজকর্মও করতে পারছিনা। ওখানে গেলে কাজকর্ম করতে পারবো। ভালভাবে থাকতে পারবো। সে কারণে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি।”

মো. আলম (২৩) বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে হালচাষ করতে পারবো। মাছ চাষ করতে পারবো। ভালভাবে ঘুমাতে পারবো। শুনেছি অনেক সুযোগ সুবিধা আছে। সে কারণে আমরা যেতে রাজি হচ্ছি।”

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান শুরু হলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় পালিয়ে আসে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, নতুন পুরাতন মিলিয়ে বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

তারা ঘিঞ্জি পরিবেশে বিভিন্ন শিবিরে অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে অবস্থান করছে। বাড়তি মানুষের চাপে উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশ ধ্বংসের পর্যায়ে পৌঁছেছে।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের চাপ কমাতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে উন্নত সুবিধাসহ নোয়াখালীর ভাসানচরে ৪৫০ একর জমির ওপর আশ্রয় শিবির নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।

সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২,৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী।

সরকারের রোহিঙ্গা সেলের প্রধান শাহ্ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, নৌ-বাহিনীর কাছে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ভাসানচরের কাজ প্রায় শেষ। এটি বসবাসযোগ্য একটি দ্বীপ।

গতবছর ৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাসানচর সফর করে সেখানে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে তিনি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে সেই সফর বাতিল হয়ে যায়।

কিন্তু বসবাসের জন্য দ্বীপটিতে অবকাঠামো তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করা হলেও জাতিসংঘের বিরোধিতা এবং রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

ইউএইচসিআর মুখপাত্র লুইস ডোনাভান এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে পুনরায় ব্যাখ্যা চেয়েছেন জাতিসংঘ।”

তিনি বলেন, “ভাসানচরে স্থানান্তর একটি সরকারি পদক্ষেপ। জাতিসংঘ মনে করে, শরণার্থীদের যে কোন স্থানান্তর হতে হবে স্বেচ্ছাধীন। সরকারও তাই বলেছেন।”

ডোনাভান বলেন, “শরণার্থীদের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ভাসানচরে তাদের নিরাপত্তা ও সেখানকার বসবাসযোগ্যতার ব্যাপারে পরিপূর্ণ তথ্য দিতে হবে।”

“ভাসানচরে স্থানান্তরের আগে সেখানে শরণার্থীদের নিরাপত্তা, বসবাসযোগ্যতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা ইত্যাদি বিষয়সমূহ একটি কারিগরি দলের মাধ্যমে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন,” বলেন তিনি।

কী আছে ভাসানচরে?

ভাসানচর প্রকল্পের দলিল অনুযায়ী, সাগরের জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করতে প্রায় ১১ বছর আগে জেগে ওঠা ভাসানচরের প্রান্ত ঘেঁষে নয় ফুট উঁচু ১৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এই বাঁধের কারণে ভাসানচরে কোনো লবণাক্ততা নেই। সেখানে স্বাদু পানির মাছ চাষ হচ্ছে। চরে গবাদিপশু ও হাঁস মুরগি পালনের সম্ভাবনা রয়েছে।

পুরো ভাসানচরে ১,৪৪০টি ক্লাস্টার হাউস রয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে ১২টি বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে ১৬টি ঘর। প্রতিটি ঘরে চারজন হিসাবে একটি বাড়িতে ৬৪ জন মানুষ বাস করতে পারবে। প্রতিটি ঘর ১৪ ফুট লম্বা ও ১২ ফুট চওড়া।

জরুরি প্রাকৃতিক দুযোগে প্রতিটি ক্লাস্টারে একটি করে আশ্রয়েকেন্দ্র রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে কাউকে সরিয়ে নিতে হলে দুটি বড় জাহাজ ও ২০টি হাই স্পিডবোট থাকবে। নির্মাণ করা হয়েছে দুটি আন্তর্জাতিক মানের হেলিপ্যাড।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।

তিনি বলেন, ওই কমিটিতে ঢাকাস্থ চীন ও মিয়ানমার দূতাবাসের কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকবে।

ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আশা করা যায় আগামী সপ্তাহের মধ্যে ওই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।