চীনা নাগরিক হত্যা: দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ

জেসমিন পাপড়ি
2020.10.23
ঢাকা
201023-BD-CH-workers-1000.jpeg ঢাকার বনানীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণে কাজ করছেন শ্রমিকরা। এই অবকাঠামোটি নির্মাণ করছে চীনা সিনোহাইড্রো কোম্পানি। ৭ জুলাই ২০২০।
[কামরান রেজা চৌধুরী/বেনারনিউজ]

পিরোজপুরে এক চীনা নাগরিক হত্যার ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টেলিফোন আলাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-কে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, যা শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন এ ঘটনায় ইতিমধ্যে প্রধান আসামিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছেন। তিনি দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন।

২০১৯ সালের জুন থেকে এ বছরের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় প্রকল্পে কাজ করা চতুর্থ কোনো চীনা নাগরিক হত্যার ঘটনা এটি।

“পিরোজপুরে চীনের নাগরিক হত্যার বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনার দ্রুত বিচারের পাশাপাশি চীনের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপের ওপর চীন সরকার আস্থাশীল,” বিজ্ঞপ্তিতে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে থাকে। দেশটি এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ​, সড়ক, সেতু, রেলসহ বিভিন্ন খাতে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে।

২০১৮ সালে বাংলাদেশের চীন ছিল সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী এবং বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

নিহত চার চীনা নাগরিক

গত বছরের জুনে পটুয়াখালির পায়রা বিদ্যুৎ​কেন্দ্রে বাংলাদেশি এবং চীনা শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন চীনা শ্রমিক মারা যান।

একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী এলাকায় জিয়ানহুই গাও (৪৭) নামে চীনের এক নাগরিকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। পুলিশের ধারণা, তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এরপর লাশ গুম করতে ভবনের পেছনের সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে খালি জায়গায় মাটিচাপা দেওয়া হয়।

এ ছাড়া গত বছরের ১৬ নভেম্বর নুডলস খাওয়াকে কেন্দ্র করে এক চীনা শ্রমিকের হাতে আরেক চীনা শ্রমিক খুন হয়েছিলেন। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া চীনা নাগরিককে সেদেশে ফেরত নেওয়া হয় বিচার করার জন্য।

সর্বশেষ ৭ ​অক্টোবর নিহত হলেন লাও ফান।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, একের পর এক চীনা নাগরিক খুন হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের। এ বিষয়ে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সচেতন থাকতে হবে। তবে এ ঘটনা দুদেশের মধ্যকার সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না বলেও মনে করেন তাঁরা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “এই দু-একটি ঘটনার জন্য বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কে অবনতি হবে না। কারণ, দুদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। বাংলাদেশ যেমন চীনকে প্রয়োজন মনে করে, তেমনি চীনেরও বাংলাদেশকে প্রয়োজন।”

“তবে এভাবে চীনের নাগরিকদের হত্যা করা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত আরও সতর্ক থাকা। যেখানে চীন কিংবা কোনো বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন, সেখানে নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ থাকা উচিত,” বলেন তিনি।

লাও ফানকে হত্যা: গ্রেপ্তার দুই

গত ৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পিরোজপুরে চীনা নাগরিক ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর প্রধান টেকনিশিয়ান লাও ফান (৫৮) গুরুতর আহত হন। পরে পিরোজপুর জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

সেই রাতেই এ ঘটনায় নির্মাণাধীন ওই সেতুর প্রকৌশলী কাও চিয়েন হুয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের নামে পিরোজপুর সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব, কোস্টগার্ড যৌথ অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেপ্তার করে।

সম্ভবত টাকা ছিনতাইয়ের জন্যই চীনা নাগরিক লাও ফানকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান পিরোজপুরের পুলিশ সুপার হায়াতুল ইসলাম খান। ঘটনার দিন ​বিকেলে লাও ফান শ্রমিকদের দেওয়ার জন্য ২ লাখ ৫৩ হাজার টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন।

পিরোজপুরের বেকুটিয়ার কচা নদীতে নির্মাণাধীন এই ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুতে ৪১ জন চীনা নাগরিক কর্মরত রয়েছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের প্রায় সাড়ে সাত হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করছে পদ্মা সেতু এবং ওই সেতুর ওপর নির্মিত রেললাইন প্রকল্পে।

মিয়ানমারের নির্বাচনের পরে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, টেলিফোন সংলাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়া হবে বলে সম্প্রতি মিয়ানমার আবারও চীনকে আশ্বস্ত করেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সাথে ফোনালাপে ওয়াং ই জানান, চীন রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে রোহিঙ্গাদের যাতে ফেরত নেওয়া যায় সে লক্ষ্যে মিয়ানমার কাজ করবে বলে চীনকে তারা জানিয়েছে।

তিনি জানান, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চীনকে মিয়ানমার জানিয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তারা বাংলাদেশের সাথে দ্রুত আলোচনা শুরু করবে।

মিয়ানমারের নির্বাচনের পর প্রথমত রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রী পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে ওয়াং ই ড. মোমেনকে আশ্বস্ত করেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ঢাকায় প্রস্তুতিমূলক সিনিয়র কর্মকর্তা পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক দ্রুত শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক তারেক শামসুর বলছিলেন, “মিয়ানমারের ব্যাপরে চীনের একটা বিরাট স্বার্থ রয়েছে। এই জাতীয় স্বার্থের কারণেই চীন মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে নিয়ে যাবে না যাতে তা নষ্ট হয়।”

“বাংলাদেশকেও চীনের প্রয়োজন। এজন্যই এই ইস্যুতে চীন দুতিয়ালির চেষ্টা করছে। কিন্তু মিয়ানমারের অসহযোগিতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকে রয়েছে,” বলেন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে আশ্রয় নেন। এর আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া চার লাখ রোহিঙ্গাসহ কক্সবাজারে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে মিয়ানমার। তবে এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।