প্রথমবারের মতো রাখাইন পরিদর্শনে যাচ্ছে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল
2023.05.03
ঢাকা ও কক্সবাজার

সম্ভাব্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আগে সেখানকার পরিস্থিতি দেখতে মিয়ানমারের রাখাইন পরিদর্শনে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল।
আগামী শুক্রবার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ২৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল মিয়ানমারে যাচ্ছে। এই দলে ২০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীও রয়েছেন।
এই প্রথমবারের মতো প্রত্যাবাসন বিষয়ে কোনো প্রতিনিধিদলে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। যদিও প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত রোহিঙ্গাদের নাম প্রকাশ করেননি বাংলাদেশি কর্মকর্তারা।
“এই সফরের উদ্দেশ্য হলো রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের উপযোগী কি না তা দেখা,” বুধবার বেনারকে বলেন মিজানুর রহমান।
শুক্রবার টেকনাফ সীমান্ত হয়ে প্রতিনিধিদল রাখাইন যাবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে। কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে সেখানে ফেরত পাঠানো যাবে না।
মিজানুর রহমান বলেন, “মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল যে এক হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে পরিচয় যাচাই-বাছাই করেছে, পাইলট প্রকল্পের আওতায় তাঁদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের এই সফরের পরে মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফরে আসার কথা রয়েছে।”
প্রত্যাবাসনের তারিখ সুনির্দিষ্ট না হলেও এই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।
এই উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো মন্তব্য করে টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মো. কাশেম বলেন, “সে দেশের পরিস্থিতি কতটা অনুকূল তা প্রতিনিধি দল রাখাইন ঘুরে এলে আরও পরিষ্কার হবে।”
“তবে আমরা যারা মিয়ানমারের থেকে পালিয়ে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছি, তারা সবাই সে দেশে নিজস্ব গ্রামে ফিরতে ইচ্ছুক। অন্য কোনো জায়গায় না,” বলেন কাশেম।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে চীনের মধ্যস্থতায় প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা চলছে। এর অংশ হিসেবে গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মংডু আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ-এর নেতৃত্বে ১৭ সদস্যর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসে।
সাত দিনে ১৪৭টি পরিবারের প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে ২২ মার্চ তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
“চীনের সহায়তায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে যাচ্ছে,” জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক খান বুধবার বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার এখন প্রত্যাবাসনে আগ্রহী। তারা বুঝতে পেরেছে যে রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলে তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর আন্তর্জাতিক চাপ আসবে।”
ফারুক খান বলেন, “চীনও মনে করে যে, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হওয়া জরুরি। সেই কারণে তারা মিয়ানমার সরকারকে বলছে যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা হোক। না হলে সমস্যা আরও বাড়বে।”
“মিয়ানমার মনে করেছিল, তারা আশিয়ান দেশগুলোর পক্ষ থেকে সমর্থন পাবে। কিন্তু তারাও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে। আমি মনে করি না যে, এক বছরে সব রোহিঙ্গা চলে যাবে। তবে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়া দরকার। একবার শুরু হলে ধীরে ধীরে প্রত্যাবাসনের গতি বাড়বে,” যোগ করেন তিনি।
সন্দিহান অনেকেই
বর্তমান প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সফলতার ব্যাপারে সন্দিহান অনেক কূটনৈতিক। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বুধবার বেনারকে বলেন, “চীন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য মধ্যস্থতা করছে ঠিকই, কিন্তু আমি মনে করি, এই সংকট নিরসনের জন্য কেবলমাত্র তাদের ওপর নির্ভর করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। তারা কতটুকু করবে সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে।”
তিনি আরও বলেন, “রোহিঙ্গারা তাদের বসতভিটায় ফেরত যেতে চায় কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাদের ১২০ দিন আইডিপি ক্যাম্পে রাখার পর তাদের গ্রামে যেতে দিতে চায়। এছাড়া, রোহিঙ্গাদের কতটুকু স্বাধীনতা দেওয়া হবে সেটিও বড়ো প্রশ্ন।”
“আগামী মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মিয়ানমারের সাবমিশন রয়েছে। এটিকে মাথায় রেখে তারা প্রত্যাবাসনের কথা বলছে। প্রতিবারই আদালতের শুনানি থাকলে তারা প্রত্যাবাসনের কথা বলে। এরপর পুনরায় তারা তৎপরতা বন্ধ করে দেয়। সুতরাং, তাদের ওপর আস্থা রাখা যায় না,” বলেন তিনি।
শহীদুল হক বলেন, “প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ মূলত অনেকটা ধোঁকা দেওয়ার মতো। আমাদের উচিত হবে তাদের এই উদ্যোগের ব্যাপারে সচেতন হওয়া।”
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ আহমাদ বেনারকে বলেন, “চীন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। যেমন তারা সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সমস্যা সমাধান করেছে। দেখা যাক, তারা রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে কি না।”
এ প্রসঙ্গে শহীদুল হক বেনারকে বলেন, “সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সমস্যা সমাধান করা এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধান এক কথা নয়, দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। আমি চীনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার সংকট নিরসনে সম্ভাবনার ব্যাপারে খুব আশাবাদী নই।”