ডেঙ্গুজ্বর: সংক্রমণ বাড়ছে ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা শিবিরে
2023.07.03
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মৌসুমি বৃষ্টিপাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে এবং অক্টোবরে কমে আসে। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেক আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি বছরে এ পর্যন্ত এক হাজার ৫৪০ জন রোহিঙ্গা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, ডেঙ্গুতে মারা গেছেন তিনজন শরণার্থী।
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সংক্রমণ কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী তৎপর রয়েছে।
কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পের মধ্যে উখিয়ার চারটি ক্যাম্পে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি।
কারণ হিসেবে সিভিল সার্জন কার্যালয় বলছে, প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরোনো খাল ও জলাশয়ের কারণে এসব ক্যাম্পে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে ডেঙ্গু মোকাবেলায় এ পর্যন্ত সাড়ে তিন লাখ মশারি বিতরণ করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের সিভিল সার্জন মেডিকেল অফিসার ফাহিম আহমেদ ফয়সাল।
“পাশাপাশি ক্যাম্পে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ ডেঙ্গু রোধে বিভিন্ন প্রচারণা চালানো হচ্ছে।” যোগ করেন তিনি।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে শরণার্থী শিবিরের ড্রেন, আবর্জনা ফেলার ডোবা এবং স্থির জলের পয়েন্টগুলো পরিষ্কার রাখা হচ্ছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজারের সহকারী ওয়াশ সেক্টর সমন্বয়কারী মো. মোস্তফা সাদেক।
সোমবার দুপুরে টেকনাফের জাদিমুড়া, শালবন ও লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে অধিকাংশ শিশুকে ড্রেনের পাশে বসে সময় কাটাতে দেখা গেছে। শালবন ক্যাম্পে তিন জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ড্রেন পরিষ্কার করছিলেন।
গত বছর কক্সবাজারের ৩৩টি শরণার্থী শিবিরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন মোট ১৫ হাজার ৩৫২ জন রোহিঙ্গা।
ঘনবসতির কারণে বিপদ বেশি
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বেনারকে বলেন, “কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসের জায়গা খুবই ঘনবসতিপূর্ণ। এর ব্যবস্থাপনা যদি সঠিকভাবে করা সম্ভব না হয় তাহলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সেখানে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।”
রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, অল্প জায়গায় এত মানুষের বসবাসের কারণে এবং কিছুটা অসচেতনতার অভাবে অপরিচ্ছন্নতা বেড়েছে।
“ক্যাম্পে এত ঘনবসতি, এখানে ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় নেই বললেই চলে,” বেনারকে বলেন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা মোহাম্মদ হোসাইন।
জনসংখ্যা অনুযায়ী শিবিরগুলোতে পর্যাপ্ত টয়লেট নেই অভিযোগ করে তিনি বলেন, “পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়েও ক্যাম্পগুলো অনেক পিছিয়ে।”
টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আবুল কালাম বেনারকে বলেন, “ড্রেন অপরিষ্কার থাকায় ক্যাম্পে আগের তুলনায় মশা বেড়েছে। অন্যদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। কারণ তারা ড্রেনের স্ল্যাবের ওপর বসে খেলাধুলা করে সময় কাটায়।”
একই ক্যাম্পে বসবাস করেন নুর নাহার। তিনি বেনারকে বলেন, “আমার ঘরে ছয় শিশু আছে। তাদের মধ্য দু’জনের কাল থেকে প্রচণ্ড জ্বর। প্রাথমিক চিকিৎসার পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি। ধারণা করছি, হয়তো তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। গত বছর আমার পরিবারের দুই সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল।”
কক্সবাজার জেলায় ডেঙ্গু জ্বরে মোট আক্রান্তের প্রায় ৯৬ ভাগই রোহিঙ্গা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ কবিরুল বাশার বেনারকে বলেন, “চলতি বছর যে হার ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা ঘটছে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি ও ঘনবসতির কারণে সেখানে সংক্রমণের হার ক্যাম্পের বাহিরের এলাকার তুলনায় অনেক বেশি।”
তিন সপ্তায় সারা দেশের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক
গত তিন সপ্তায় সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
চলতি বছরের জুন মাসের শুরুর দিকে (জুন ৯) দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৮৬৫ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ২১ জন।
প্রায় তিন সপ্তাহের ব্যবধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী সোমবার আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১৯৩ জনে এবং মৃতের সংখ্যা ৫৬। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন গত ২৪ ঘণ্টায়।
উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে রোহিঙ্গাদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।