ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে
2023.08.04
ঢাকা

দেড় বছরের শিশু কন্যার বাবা মীর আশরাফুজ্জামান শুক্রবার দুপুরে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের সামনে বিষণ্ণ চেহারায় পায়চারি করছিলেন। তাঁর শিশুকন্যা ওই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।
প্রচণ্ড জ্বরের পরে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দিলে বৃহস্পতিবার ভোরে শিশুটিকে ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকার বারডেম জেনারেল হাসপাতালে-২ (মহিলা ও শিশু) ভর্তি করা হয়।
“এখন সন্তানের অবস্থা একটু ভালোর দিকে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি,” বেনারকে বলেন আশরাফুজ্জামান।
এই বাবাই একা নন, এমন অনেকেই হাসপাতালের আঙিনায় ঘুরছেন। কারণ শহরের সব সরকারি হাসপাতাল রোগীতে ভরে গেছে। এখন চাপ বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও।
বছরের প্রায় পাঁচ মাস বাকি থাকতেই, বৃহস্পতিবার জানা যায় পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো একক বছরে সর্বোচ্চ ২৮৩ জনের মৃত্যু হলো ডেঙ্গুতে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এর আগে গত বছরে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ২৮১ জনের মৃত্যুর রেকর্ড করা হয়েছিল, যা ২০০০ সালের পরে সর্বোচ্চ। ২০০০ সাল থেকেই সরকারিভাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান রাখা শুরু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে শুক্রবার জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে আরও ১০টি নতুন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ফলে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯৩ তে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে দেশে ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে মারা যান, ২০২১ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০৫।
তিন বছর বয়সী ছেলের মা আছিয়া বেগম তাঁর ছেলেকে ভর্তি করতে কাকরাইল এলাকার ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ছুটে আসেন শুক্রবার দুপুরে। শহরের অন্যতম প্রধান সরকারি হাসপাতাল মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল গিয়ে তিনি তার সন্তানকে ভর্তি করতে পারেননি।
“হাসপাতালে জায়গা না থাকায় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। মেঝেতে অস্থায়ীভাবে তৈরি করা বেডগুলোও খালি নেই। আমার ছেলের জীবন বাঁচাতে আমরা এখন এই বেসরকারি হাসপাতালে একটি বেড পাওয়ার চেষ্টা করছি,” বেনারকে বলেন আছিয়া।
চরিত্র পাল্টেছে মশার, ছড়াচ্ছে দ্রুত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা এখন তাদের প্রজনন এবং কামড়ের ধরন পরিবর্তন করছে। গ্রামীণ এলাকায়ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। আগের বছরগুলোতে গ্রামের মানুষের তুলনায় শহরে শনাক্ত বেশি হলেও এবারের চিত্র ভিন্ন। এ বছর গ্রামীণ এলাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় শনাক্তের হার বেশি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বেনারকে বলেন, “মশার চরিত্রে এ ধরনের পরিবর্তন দ্রুত বিস্তার ও ঝুঁকি বাড়ার একটি বড়ো কারণ হয়ে উঠেছে।”
“এডিস মশা ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রাথমিক বাহক। এই মশা এখন অপরিষ্কার এবং স্বচ্ছ দুই রকম পানিতেই বংশ বিস্তার করে। আগে এডিস মশা দিনের বেলায় মানুষকে কামড়াত, কিন্তু এখন রাতেও কামড়াচ্ছে,” বলেন কবিরুল।
কীটতত্ত্ববিদদের অনুসন্ধানের কথা উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি রশিদ-ই-মাহবুব বেনারকে বলেন, “ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামীণ এলাকায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয় না। কিন্তু এই বছর সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, বিপুল সংখ্যক রোগী স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন বা ডেঙ্গু নিয়ে ঢাকায় আসছেন। তার মানে গ্রামীণ এলাকাতেও মানুষ এখন আগের বছরের তুলনায় বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত,” বলেন তিনি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজিএইচএস) সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের লাইন ডিরেক্টর মো. নাজমুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চিকিৎসা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দায়িত্ব নয়। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, মশার বংশ বৃদ্ধি রোধে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছেন তারা।
“এডিসের লার্ভা পাওয়ায় আমরা অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করছি। বছরজুড়ে এই অভিযান পরিচালনা করা হবে। লার্ভা পেলেই জরিমানা,” বলেন আতিক।
ডিজিএইচএস ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. শাহাদাত হোসেন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, বেশির ভাগ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুতে মারা যায়, কারণ মৃতদের গড় হাসপাতালে থাকার সময় ছিল তিন দিনের কম।
সরকারি তথ্যমতে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত এই বছর মোট ৬১ হাজার ৪৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।