মানবাধিকার প্রতিবেদন: সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীদের নিষ্পেষণ উদ্বেগজনক

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.01.12
ঢাকা
মানবাধিকার প্রতিবেদন: সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীদের নিষ্পেষণ উদ্বেগজনক ঢাকায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সংলগ্ন এলাকা থেকে আটক করা এক বিএনপি কর্মীকে প্রিজন ভ্যানে তোলার জন্য নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ৭ ডিসেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও নিষ্পেষণের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ)।

২০২২ সালে বিশ্বের প্রায় একশ’ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়, আগামী সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হবে বলে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার যে আশ্বাস দিচ্ছে, তা প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এই প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে।

তবে এ বিষয়ে মতামত জানতে যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেন, “এই প্রতিবেদন পক্ষপাতমূলক।”

প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিবিরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) হাতে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রতিবেদন বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, “আন্তর্জাতিক নজরের প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের কথা বলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু ক্রমবর্ধমান নিষ্পেষণে তাদের এই কথা প্রমাণিত হয় না।”

তিনি বলেন, “স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় কোনো প্রকার ভয়-ভীতি ছাড়া বাংলাদেশিরা যাতে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং তাদের পছন্দ মতো নেতা নির্বাচিত করতে পারে সে ব্যাপারে দাতা এবং কৌশলগত অংশীদারদের জোর দিতে হবে।”

প্রতিবেদনের সূচনা অংশে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তিরানা হাসান বলেন, বর্তমান বিশ্বে ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তিত হওয়ায় মানবাধিকার রক্ষার জন্য কেবলমাত্র উন্নত বিশ্বের ওপর নির্ভর করা যায় না।

মানবাধিকার রক্ষার জন্য ছোট-বড়ো সব দেশকে তাদের নিজস্ব আইনি কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে সম্মিলিতভাবে মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে এবং উৎসাহ দিতে হবে বলে জানান তিনি।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ‘কালো আইন’

প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর কিছু কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন সরকারের অবরোধ আরোপের পর অল্প সময়ের মধ্যেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম বন্ধ হয়ে যায়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সংস্কার পরিচালনার পরিবর্তে যে কারণে র‍্যাবের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে হুমকি এবং ভয়-ভীতি প্রদর্শন শুরু করা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘কালো আইন’ আখ্যা দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই আইনের আওতায় সরকার সমালোচকদের আটক করতে থাকে।

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনা করায় নভেম্বর মাসে বিরোধীদলীয় নেতা সুলতানা আহমেদকে আটক করা হয়। বিরোধীদল বিএনপি বলছে, তাদের দলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২০ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে, যেগুলোতে আসামিদের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, সরকার বিদেশে বসবাসকারী বিরোধীদেরও ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, একটি ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে প্যারিসে বসবাসকারী ব্লগার পিনাকী ভট্টাচার্য এবং ঢাকায় অবস্থানকারী দু’জনের বিরুদ্ধে গত বছরের নভেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।

বাংলাদেশি জাতীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের” অভিযোগে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রদানকারী ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই সব ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, সরকার মানবাধিকার সংগঠনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর নিবন্ধন নবায়ন করতে দেওয়া হয়নি এবং সংগঠনটির সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এএসএম নাসিরুদ্দীন এলানকে নজরদারিতে রেখে অনেকদিন ধরে হয়রানি করে চলেছে।

প্রতিবেদন সঠিক: বিএনপি

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনের ব্যাপারে বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দীন স্বপন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এই প্রতিবেদনে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার একটি সঠিক চিত্র ফুটে উঠেছে। সরকার যেভাবে বিরোধীদের নিষ্পেষণ করছে তা উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধীদের একটি নৈতিক সমর্থন এসেছে।”

তিনি বলেন, “একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করে আসছে, এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সেই দাবির প্রতি সমর্থন আরও জোরালো হলো।”

অভিযোগ অসত্য: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদনে বিরোধী দলের সদস্যদের নিষ্পেষিত করা হচ্ছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, সেগুলো অসত্য বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

প্রতিবেদন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বৃহস্পতিবার বেনারকে তিনি বলেন, “আমরা বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের নিষ্পেষণ করছি কোথায়? আটক করলে তাদের সমাবেশে এত মানুষ কোথা থেকে আসছে। তাঁদের যেসব নেতা আটক হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পূর্বে দায়ের করা বিভিন্ন মামলা রয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা বিরোধীদলকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সমাবেশ করতে বাধা দিচ্ছি না। আমাদের দলীয় প্রধান বারবার বলছেন, পরবর্তী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হবে।” 

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ

প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিবিরে মানবাধিকারের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের পরিচালিত বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে, রোহিঙ্গাদের দোকান ভেঙে দিয়েছে এবং তাঁদের চলাচলের ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এপিবিএন সদস্যরা রোহিঙ্গাদের হুমকি দিচ্ছে, চাঁদাবাজি ও ইচ্ছামতো আটক করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সরকার মিয়ানমারের ভাষায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা প্রদানের জন্য মানবিক সংস্থাগুলোকে অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু তাঁদের জন্য কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার ব্যবস্থা করেনি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে আট হাজার রোহিঙ্গাকে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে জেগে ওঠা ভূ-খণ্ড ভাসানচরে স্থানান্তর করে। সব মিলিয়ে সেখানে বর্তমানে ২৮ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।

তবে সেখানে তাদের চলাচলের সুবিধা নেই। রয়েছে খাদ্য ও ওষুধের সংকট এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার সংশ্লিষ্টতা থাকলেও রোহিঙ্গাদের দেশের মূল ভূ-খণ্ডে আসতে দেওয়া হয় না।

উখিয়ার বালুখালী ৯ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মো. জামাল হোসেন (৫৮) বেনারকে বলেন, “এপিবিএন-এর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তারা আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে ঠিক কিন্তু বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে যে অবস্থা চলছে, এখানে কারো সেফটি সিকিউরিটি নেই। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো যাকে টার্গেট করছে, সুযোগ বুঝে তাকে মেরে চলে যাচ্ছে।”

“এমনকি আজ দিনের বেলায় ২০ থেকে ৩০ জন সন্ত্রাসী ক্যাম্প-৮ ইস্ট-এ’তে শো ডাউন করছে,” বলেন তিনি।

জামাল বলেন, “ক্যাম্পগুলোতে যেসব গ্রুপ অপহরণ, হত্যাসহ নানা অপরাধ করছে, তাদের সঙ্গে এপিবিএন-এর বোঝাপড়া রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের কিছু কিছু মাঝিও পুলিশকে সহযোগিতা করে।”

একই ক্যাম্পের নেতা সুলতান আহম্মদ (৪৩) বেনারকে বলেন, “এই ক্যাম্প এবং আশেপাশের কয়েকটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী আছে, যাদের কাছ থেকে মাসোহারা নেয় এপিবিএন-এর কিছু সদস্য। টাকা দিতে একটু দেরি হলেই নানাভাবে হয়রানি করে।”

প্রতিবেদনে এপিবিএন’র বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে আসাদুজ্জামান খান বলেন, “এপিবিএন যদি রোহিঙ্গা শিবিরে না থাকে তাহলে সাধারণ রোহিঙ্গা বাঁচতে পারবে না। রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি করে শেষ হয়ে যাবে।”

“বরং এপিবিএন থাকার কারণে ক্যাম্পে খারাপ লোক, সন্ত্রাসীরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের তেমন কিছু করতে পারছে না। তাই তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ দুঃখজনক,” বলেন তিনি।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার থেকে সুনীল বড়ুয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।