মানবাধিকার প্রতিবেদন: অধিকার লঙ্ঘনের পুরনো পথেই বাংলাদেশ
2022.01.13
ঢাকা

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলছে, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের কর্মকাণ্ডে গত বছর এটা পরিষ্কার যে, সরকার মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর দিকে নজর দেয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয়।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এইচআরডব্লিউ’র মানবাধিকার বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়, “বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক ঘটনাগুলোকে আমলে নিয়ে তা নিরসনে উদ্যোগী হওয়ার আন্তরিকতা দেখায়নি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার।”
“সমালোচক, সাংবাদিক এবং শিশুসহ যারাই সরকারের কোভিড-১৯ মোকাবেলার বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বা সাহস দেখিয়েছে তাদের উপরই নেমে এসেছে সরকারি দমন-পীড়ন,” বলা হয় এই প্রতিবেদনে।
সংগঠনটির এই প্রতিবেদনকে দেশের মানবাধিকারকর্মীরা যথার্থ বললেও সরকারের মতে, প্রতিবেদনটি বাস্তবসম্মত নয় এবং এটি সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণার অংশ।
বিচারবহির্ভূত হত্যা চলছেই
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী দায়মুক্তির সাথে জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেব মতে, গত ১০ ডিসেম্বর পুলিশ ও ব়্যাবের সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর গত ৩৪ দিনে দেশে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
সর্বশেষ, ১০ ডিসেম্বর বরিশালে একটি ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
আসকের তথ্য মতে, গত বছর দেশে বিভিন্ন বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৮০ জন। এ হিসেবে প্রতি মাসে ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন প্রায় সাতজন করে।
এর আগে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে পুলিশের হাতে ক্রসফায়ারে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার পর দেশে ক্রসফায়ারের ঘটনা কমতে থাকে এবং ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশে কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি বলে জানায় আসক।
গুম ব্যক্তিদের স্বজনেরাও ‘হেনস্তার শিকার হন’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়, “গত আগস্ট মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু সরকার ওই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করে।”
“কোনো কোনো ক্ষেত্রে জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং কখনো কখনো এই স্বজনেরা গুম ও হেনস্তার শিকার হন।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিনা বিচারে নয় মাস জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ। তিনি সরকারের কোভিড-১৯ মোকাবিলা নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনা করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা একটি মামলায় আটক হন।
এই একই ঘটনায় আটক হন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। কিশোর কারাগার থেকে বেরিয়ে বন্দি অবস্থায় চরম নির্যাতনের বিষয়ে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। উল্লেখ্য, পিবিআই তদন্ত করে বলেছে যে, তাঁর ওপর নির্যাতন হয়নি।
“বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী তথা পুলিশ, র্যাব ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে বন্দি, আটক ও সন্দেহভাজনদের ওপর নির্যাতন চালানোর ব্যাপক অভিযোগ আছে,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
ভিন্নমতের ওপর চরম নিপীড়ন
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে অধিকারকর্মীরা প্রতিনিয়ত নজরদারি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা এবং নির্বিচারে আটকের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।
“সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্ট ও সরকারের সমালোচকদের ইচ্ছেমতো হয়রানি ও আটক রাখার জন্য সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে বাক স্বাধীনতার ওপর,” বলা হয় এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদনে।
গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে কমপক্ষে ৮০জন সাংবাদিক আক্রমণের শিকার হয়ে হতাহত হয়েছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মে মাসে করোনাভাইরাস মোকাবিলা সংক্রান্ত অনিয়মের বিষয়ে প্রতিবেদন করার প্রেক্ষিতে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।
“যেসব বাংলাদেশী অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক বিদেশে রয়েছেন তাঁদের দেশে থাকা স্বজনেরা সরকারের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন। এটা ব্যাপকভাবে আলোচিত যে, গণমাধ্যমের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের ফলে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা নজিরবিহীন মাত্রায় সেলফ সেন্সরশিপ চালু করেছেন,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
সরকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি
এইচআরডব্লিউ-এর এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক বছর আগে থেকেই হত্যার হুমকি পেতে থাকা রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে অজ্ঞাত পরিচয় অস্ত্রধারীরা হত্যা করেছে এবং তার পরের মাসেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্রধারীদের হাতে খুন হন আরো সাতজন রোহিঙ্গা। সরকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি বলেই এমনটি ঘটেছে বলে দাবি করা হয় এই প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরের দুর্গম দ্বীপ ভাসানচরে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক হলেও তার আগেই সরকার সেখানকার বাসযোগ্যতা, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের প্রযুক্তিগত মূল্যায়নের জন্য অপেক্ষার প্রতিশ্রুতি না মেনেই সেখানে প্রায় বিশ হাজার শরণার্থীকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ভাসানচরকে ‘মধ্য সাগরের দ্বীপ জেল’ হিসেবে অভিহিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “দ্বীপের মধ্যে শরণার্থীরা অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা, অপর্যাপ্ত শিক্ষা সুবিধা এবং স্বাধীন চলাফেরার ক্ষেত্রে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আসছেন।”
“দ্বীপে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর স্বেচ্ছায় হয়েছে এমন দাবি সরকারের পক্ষ থেকে করা হলেও, অনেক রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে তাদেরকে দ্বীপ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা না দিয়েই,” বলা হয় প্রতিবেদনে।
এ কারণেই শতশত রোহিঙ্গা দ্বীপ থেকে পালানোর চেষ্টা করেছেন, যাদের অনেক সমুদ্রে ডুবে মারা গেছেন এবং অনেকেই পুলিশের হাতে আটক হয়ে কোনো অভিযোগ ছাড়াই কারাভোগ করছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াত বেনারকে বলেন, “রোহিঙ্গাদের সম্মতি ছাড়া বা পুরোপুরি অবগত না করে ভাসানচরে পাঠানোর অভিযোগ সত্য নয়। পূর্ণ সম্মতির ভিত্তিতেই তাদেরকে ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে।”
রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ হত্যা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও উখিয়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) গাজী সালাউদ্দিন বেনারকে বলেন, “মামলাটির তদন্ত চলমান রয়েছে সে কারণে এটার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলা এখন সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, এই মামলায় মোট ১২জন সন্দেহভাজন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে চারজন হত্যাকাণ্ডের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
প্রতিবেদন ‘যথার্থ’
এইচআরডব্লিউর এই প্রতিবেদনকে যথার্থ বলছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।
তিনি বেনারকে বলেন, “গত বছরও আমরা দেখেছি সরকার গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বিরুদ্ধমতকে দমন করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করতে। এই বিষয়গুলো নিয়ে যেসব আপত্তি আছে তার বিষয়ে সরকারকে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।”
তিনি বলেন, তাঁর সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র গত ৩১ ডিসেম্বর মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন প্রকাশের পর পুলিশ নানা রকম খোঁজ-খবর করছে।
“সরকার যদি আমাদের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চায় তাহলে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করা উচিত। সবকিছুকে পুলিশি কায়দায় দেখাটা চাপ প্রয়োগ ছাড়া কিছু নয়,” বলেন নূর খান।
গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাক এর সমন্বয়কারী আফরোজা ইসলাম আঁখি বেনারকে বলেন, “এটা খুবই সত্য যে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতার পরিবর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা আরও হয়রানির শিকার হন।”
তিনি বলেন, “এমন অনেক পরিবার আছে যারা থানায় থানায় ঘুরেও একটা জিডি করারও সুযোগ পায় না।”
‘অবাস্তব’ প্রতিবেদন
এই প্রতিবেদনটিকে ‘অবাস্তব এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মনে করেন সরকারের আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মন্ত্রিসভার এই জ্যেষ্ঠ সদস্য বেনারকে বলেন, “তারা যদি অভিযোগগুলোর বিষয়ে আমাদের নির্দিষ্টভাবে জানায়, তাহলে সরকার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু তারা সবসময় যেভাবে ঢালাও অভিযোগ করে তা পুরোপুরি অবাস্তব।”
বাংলাদেশের সরকার মানুষের অধিকার সম্পর্কে খুবই সচেতন দাবি করে তিনি বলেন, “হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সব সময়ই সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত।”