সীমান্ত এলাকায় মর্টার শেল: মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ ঢাকার
2022.08.29
কক্সবাজার

মিয়ানমার থেকে আসা দুটি মর্টার শেল বান্দরবন সীমান্তে পড়ার ঘটনায় ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মো-কে ডেকে কড়া প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ।
সোমবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “মিয়ানমার ইস্যুতে রাষ্ট্রদূতকে আজকে আমরা ডেকেছি।”
“তাদেরকে একটা নোট ভার্বালের (কূটনৈতিক পত্র) মাধ্যমে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি, এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না হয়। এ ঘটনা যে ঘটেছে সেটার জন্যও আমরা তীব্র নিন্দা জানিয়েছি,” বলেন তিনি।
গতকাল রোববার বেলা তিনটার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রু বাজার এলাকায় জনবসতিতে এসে পড়ে। সেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি। হতাহতের ঘটনাও ঘটেনি। পরে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি)।
সঙ্গে সঙ্গে ওই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে রোববার বিকেলে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশের সীমান্তে অবিস্ফোরিত মর্টার শেল পড়ার বিষয়টি দুর্ঘটনা নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেটা খতিয়ে দেখা হবে। দুর্ঘটনাবশত হলে মিয়ানমারকে সতর্ক করা হবে।”
ওই ঘটনার জেরেই গতকাল মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে এর আগেও মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া বিস্ফোরিত মর্টারের অংশ বাংলাদেশ সীমানায় পেড়ে। এছাড়া আকাশসীমা লঙ্ঘন করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে।
এসব ঘটনার প্রতিবাদে গত ২১ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানায়। মিয়ানমারের এসব কর্মকাণ্ড প্রতিবেশীসুলভ ও বন্ধুত্বের নিদর্শন নয়—কঠোর ভাষায় সেই বার্তা দিয়ে প্রতিবাদলিপি হস্তান্তর করা হয়।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের এসব কর্মকাণ্ডের কঠোর নিন্দা জানিয়ে সুপ্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের কাছে আরও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে বাংলাদেশ।
বারবার সতর্ক করার পরেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং অকূটনৈতিক আচরণ বলে মনে করছেন কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এহসানুল হক বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের এ ধরনের আচরণ অবন্ধুসুলভ। এটা যদি উদ্দেশ্যমূলক হয় তা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্টত লঙ্ঘন। এজন্য তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।
“আর যদি এই মর্টার শেলগুলো উদ্দেশ্যমূলকভাবে না ছুঁড়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের কাছে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত মিয়ানমারের। সেটা না করাটা অকূটনৈতিক,” মনে করেন এহসানুল হক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্ত প্রায় ৬৫ কিলোমিটারের।
আতঙ্কিত স্থানীয়রা, সতর্ক বিজিবি
বান্দরবনের জনবসতি এলাকায় মিয়ানমারের ছোঁড়া মর্টার শেল পড়ার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা। তবে সীমান্তে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা।
বান্দরবনের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রু বাজার এলাকায় মিয়ানমারে দুটি মর্টারের গোলা জিরো লাইন থেকে ৫০০-৬০০ গজের মধ্যে পড়ে। মর্টার শেল দুটি একটা আরেকটা থেকে ২০০ গজ দূরে পড়ে।
পুলিশ সুপার বলেন, “এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যকার ভয়ভীতি কাটানোর জন্য এটি একটি দুর্ঘটনা বলে বোঝানো হচ্ছে । মর্টার শেল দুটি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে বসবাসকারীদের সর্তক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, গত জুন থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দক্ষিণ-পূর্ব কাহাহ এবং কাইন ও উত্তর-পশ্চিম চীন রাজ্যে এখনো সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানকার গ্রাম ও আবাসিক এলাকায় বিমান দিয়ে গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যেও আরাকান আর্মির সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ চলছে।
বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কারণে সেদেশে সীমান্তে ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। এপারে মর্টার শেল উড়ে আসার ঘটনায় আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। পাশাপাশি সীমান্তে বিজিবি সর্তক অবস্থানে রয়েছে। সীমান্তের লোকজন যাতে আতঙ্কে না থাকে, সেজন্য বিজিবি কাজ করছে।”
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, “মিয়ানমার সীমান্তে এখনো গোলাগুলি শব্দ পাওয়া যায়। ফলে সীমান্তের লোকজন ভয়ের মধ্য রয়েছে। এরপরও যাতে লোকজন আতঙ্কে না থাকে সেজন্য আমাদের পক্ষ থেকে বুঝানো হচ্ছে।”
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করলে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেন। আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এর আগে বিভিন্ন সময়ে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। সবমিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি শিবিরে বসবাস করছেন বলে সম্প্রতি জানান বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব।
রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও ফিরতে পারেননি। তবে কক্সবাজারের শিবির থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরিত করেছে সরকার। প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়ার কথা রয়েছে।