রোহিঙ্গা শিবিরে দুই দলের বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৫
2023.07.07
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র দুটি রোহিঙ্গা দলের গোলাগুলিতে শুক্রবার ভোরে পাঁচ জন নিহত হয়েছেন।
উখিয়ার বালুখালী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষে এই নিহতের ঘটনা ঘটে বলে বেনারকে জানান ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড মিডিয়া) ফারুক আহমেদ।
নিহত সবাই আরসার সদস্য বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
নিহত পাঁচ রোহিঙ্গার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার পাঠানো হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী।
সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ এপিবিএন অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) আমির জাফর বেনারকে জানান, শুক্রবার ভোরে শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের দুই দল দুষ্কৃতকারীর গুলির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তিনজনের মরদেহ পাওয়া যায়। আহত বাকি দুই জনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁরা সেখানে মারা যান।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে নিহতরা “আরসার সদস্য” জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।”
এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ওসি মোহাম্মদ আলী জানান, নিহতদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন (২৪) ও মোহাম্মদ হামীম (১৬) ক্যাম্প-৮, নুরুল আমিন (২৪) ক্যাম্প-১৩ এবং মো. নজিমুল্লাহ ক্যাম্প-১০ এর বাসিন্দা। তবে নিহত অন্যজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
শরণার্থী শিবিরে দিন দিন “হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাড়ছে” মন্তব্য করে উখিয়া বালুখালী শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণে আরসা এবং আরএসও’র দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ফলে সাধারণ রোহিঙ্গারা খুব ভীতির মধ্য রয়েছে।”
তিনি বলেন, “এমনিতে দুই দফায় খাদ্য রেশন কমিয়ে দেওয়ায় আমরা বিপদের মধ্যে আছি। তার ওপর ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গ্রুপের হাতে জীবন হারানোর ভয়ও আমাদের তাড়া করছে।”
“ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া। এসব সশস্ত্র গ্রুপের কারণে আমরা সাধারণ রোহিঙ্গারা খুব বিপদে পড়েছি,” শুক্রবার বেনারকে বলেন বালুখালী শিবিরের বাসিন্দা শরণার্থী নূর হাফেজ।
সৈয়দ উল্লাহর মতে, প্রত্যাবাসনের দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তায় রোহিঙ্গারা হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে এবং এর মধ্যেই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে।
“এসবের একমাত্র সমাধান হচ্ছে শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন। এটির জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে ক্যাম্পে খুন-খারাবি বাড়তেই থাকবে,” বলেন সৈয়দ উল্লাহ।
‘পরিস্থিতি মোকাবেলা কঠিন’
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শরণার্থী শিবিরগুলোতে আরসা ও আরএসও-সহ ১১টি সক্রিয় সশস্ত্র দুর্বৃত্ত দল সক্রিয় রয়েছে। এবং শিবির এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র সশস্ত্র দলগুলো “প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।”
এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ও অভিবাসন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বেনারকে বলেন, “এটা পরিষ্কার যে, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো অনেকটাই ব্যর্থ।”
“বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বড়ো ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে লিপ্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সত্যিই কঠিন,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
তাঁর মতে, “আমাদের বাহিনীগুলোর সক্রিয়তা ও গোয়েন্দা তৎপরতার কারণে অপরাধ অনেক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে এসব সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন খুবই ভয়াবহ তৎপরতার মধ্যে রয়েছে।”
পুলিশের তথ্যমতে, ইয়াবা, মানব পাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে শরণার্থী শিবিরের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয়। এসব কারণেই তাদের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
“ক্যাম্পে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে” খুন বাড়ছে স্বীকার করে এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বেনারকে বলেন, “যারা অপরাধে জড়াবে, তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এর আগে শরণার্থী শিবিরে আরসার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়নি। তবে মাস কয়েক আগে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দলের হাতে গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্যকে হত্যার পর আরসা সদস্যদের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়।
পুলিশের তথ্য অনুসারে, গত ১১ দিনে রোহিঙ্গা শিবিরে নয় জন খুন হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই আরসার সদস্য ছিলেন। কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবিরে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১৭৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি বছরের সাত মাসে (৭ জুলাই পর্যন্ত) একাধিক সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় অন্তত ৫৯ জন মারা গেছেন।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক, সাধারণ রোহিঙ্গা ও বিবদমান সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা।
‘রোহিঙ্গারা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না’
চলতি সপ্তাহে কক্সবাজার সফর শেষে সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান শুক্রবার বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে অবশ্যই ত্বরান্বিত করতে হবে এবং বিশ্ব চলমান এই সংকট থেকে মুখ ফিরিয়ে
নিতে পারে না। তারা মনে করছে, বিশ্বের দৃষ্টি এখন ইউক্রেনসহ অন্য কোনো দিকে।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার দায়ের করা গণহত্যা মামলা এবং ‘সার্বজনীন ন্যায়বিচারের’ নীতির অধীনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আর্জেন্টিনার বিচার বিভাগ কর্তৃক গৃহীত আরেকটি মামলার সাথে আইসিসির তদন্ত সমান্তরাল, তবে পৃথকভাবে চলছে।
শুক্রবার কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফিরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সংবাদ সম্মেলনে করিম খান বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী, জাতিসংঘ ও অন্যান্যদের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন যে, রোহিঙ্গারা পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, “মার্চের আগে রোহিঙ্গারা তিন বেলা খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পেতো। কিন্তু মার্চের পর থেকে তারা দুই বেলা খাবার খাচ্ছে; এমনকি কখনও দুই বেলা পাচ্ছে না।”
করিম খান বলেন, “প্রতি বেলা খাবারের জন্য নয় টাকা দিয়ে কী হয়? একটি ডিমের দাম এখন ১২ টাকা।”
তিনি বলেন, বিষয়টি আমাদের অন্তর দিয়ে বুঝতে হবে এবং তাদের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে।”
উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। তাদের মধ্যে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে কক্সবাজারে পালিয়ে আসেন।