বিশ্বব্যাংকের ঋণ ও অনুদানে রোহিঙ্গা এবং স্থানীয়দের জন্য দুটি প্রকল্প
2024.05.28
ঢাকা

বিশ্বব্যাংকের ঋণ ও অনুদানের পাশাপাশি সরকারি অর্থায়নে বাংলাদেশে বসবাস করা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে আট হাজার ৪৮২ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ সরকার।
রোহিঙ্গা এবং সংশ্লিষ্ট স্থানীয়দের জন্য গৃহীত প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক থেকে এই প্রথম বাংলাদেশ ঋণ নিলো বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা সেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব মো. হাসান সারোয়ার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মঙ্গলবার পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় মঙ্গলবার প্রকল্প দুটি পাস হয়।
এই প্রকল্প দুটির মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ এবং প্রকল্প অনুদান—দুটি অংশ রয়েছে জানিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শহীদুজ্জামান সরকার মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, প্রকল্পগুলোর কিছু কাজ ঋণের অর্থে এবং কিছুটা অনুদানের অর্থে বাস্তবায়িত হবে।
“আমরা এই প্রকল্প দুটির জন্য দেওয়া অনুদানের অর্থ রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যবহার করব। ঋণের অর্থ ব্যবহৃত হবে স্থানীয় জনগণের জন্য,” বলেন প্রতিমন্ত্রী।
জীবনমান উন্নয়নে সরকারের যত পরিকল্পনা
বেনারের হাতে আসা প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, প্রকল্প দুটি ২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৮ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়িত হবে।
অবকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত প্রথম প্রকল্পের নাম “হোস্ট অ্যান্ড ফোরসিভলি ডিসপ্লেসড মিয়ানমার ন্যাশনালস/ডিসপ্লেসড রোহিঙ্গা পপুলেশন ইনহ্যান্সমেন্ট অব লাইভস থ্রু আ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচ প্রজেক্ট”।
প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রায় চার হাজার ৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ হিসেবে প্রায় দুই হাজার ৩৩০ কোটি এবং অনুদান হিসেবে এক হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা দেবে। সরকার দেবে প্রায় ২৬৭ কোটি টাকা।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে বান্দরবান সদর, নাইক্ষ্যংছড়ি ও লামা, কক্সবাজারের সব উপজেলা, নোয়াখালী সদর, ভাসানচর, সুবর্ণচর, হাতিয়া, চাটখিল, সোনাইমুড়ী, কবিরহাট, কোম্পানিগঞ্জ, সেনবাগ ও বেগমগঞ্জে।
প্রকল্পের আওতায় সড়ক নির্মাণ ও উন্নয়ন, আট মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও বিতরণ অবকাঠামো নির্মাণ, নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন সুবিধা বৃদ্ধি, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, পরিবেশগত প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসহ কিছু কাজ করা হবে।
“ইনক্লুসিভ সার্ভিসেস অ্যান্ড অপরচুনিটি ফর হোস্ট কমিউনিটি অ্যান্ড ফোরসিভলি ডিসপ্লেসড মিয়ানমার ন্যাশনাল পপুলেশন প্রজেক্ট” প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে চার হাজার ৪০১ কোটি টাকার বেশি, যার মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ দুই হাজার ১৪৫ কোটি টাকা এবং অনুদান এক হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা।
রোহিঙ্গা-স্থানীয়দের সংকট কাটাতে প্রকল্প
দ্বিতীয় প্রকল্পটির যথার্থতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময় মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম বিভাগের প্রতিটি জেলায় মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ওই এলাকাগুলোতে আর্থ-সামাজিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
গত বছরের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার যৌথ নিবন্ধন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।
বিভিন্ন মানবিক সহায়তা দেওয়ার পরও রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং সহিংসতা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এখনো উচ্চমাত্রায় সংকট রয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার মানবিক সহায়তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
প্রকল্প নথিতে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসহ বিভিন্ন সূচকে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, নোয়াখালী ও কক্সবাজার জেলা তুলনামূলকভাবে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, মানব পাচার, বাল্যবিয়ে, বহুবিয়ে এবং যৌন হয়রানির মতো অপরাধ বেড়ে গেছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
প্রকল্প যথার্থতায় আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পভুক্ত এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের জন্য অধিকতর কার্যকর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা পরিষেবা সম্প্রসারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করা গেলে সংকটময় পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হতে পারে।
“রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এক সময় সংঘাত দেখা দেবে, যা কারও জন্য মঙ্গলজনক হবে না,” বলেন তিনি।
আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, “প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেও প্রত্যাশা ছিল অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে যেতে পারবে। ইতোমধ্যে সাত বছর পার হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ কমেছে। বিশ্বব্যাংকের এই অনুদান রোহিঙ্গাদের কষ্ট কিছুটা হলেও দূর করবে।”
“এই প্রকল্পে স্থানীয় নাগরিকদেরও উন্নয়ন হবে। তাদের অভাব কিছু কাটতে পারে। কেননা অনেক বাংলাদেশি (স্থানীয় লোক) অভাবের কারণে ক্যাম্পভিত্তিক মানব পাচারে জড়িয়ে পড়ছে,” বলেন তিনি।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত বছরের জুনে রোহিঙ্গাদের জন্য মাথাপিছু মাসিক খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ ১০ ডলার থেকে কমিয়ে আট ডলার নির্ধারণ করে। এর আগে এই বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করা হয়।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থা চলতি বছরের মার্চে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের জন্য পরবর্তী এক বছরের মানবিক খরচ বাবদ ৮৫২ মিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রার্থনা করে। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি সাহায্য মিলেছে।
টেকনাফ থেকে প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আব্দুর রহমান।