বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী ও শিশু পাচার উদ্বেগজনক: জাতিসংঘ দূত
2022.11.09
ঢাকা ও কলকাতা

বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী ও শিশু পাচার উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এই সমস্যা সমাধানের জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। মানবপাচার সম্পর্কে বাংলাদেশে দশ দিনের সফর শেষে নারী ও শিশু পাচার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি সিয়োভান মুলালি বুধবার এ কথা জানিয়েছেন।
বিশেষ করে ভারতে বাংলাদেশি নারী ও শিশু পাচারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মুলালি।
ঢাকার সোনারগাঁও হোটেল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মুলালি আরও বলেন, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরাও মানবপাচারের অন্যতম ঝুঁকিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ ভয়াবহ ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়।
মুলালি সিলেট, কক্সবাজার ও ঢাকায় বিভিন্ন অংশীজনের সাথে কথা বলেছেন এবং আগামী বছর জুনে বাংলাদেশ থেকে নারী ও শিশুসহ মানবপাচারের ওপর জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে প্রতিবেদন পেশ করবেন।
ভারতে পাচার ‘মারাত্মক উদ্বেগের’ বিষয়
মুলালি বলেন, “যৌনদাসী হিসাবে বাংলাদেশের ভেতরে এবং সীমান্তের ওপারে বিশেষ করে ভারতে নারী ও মেয়ে শিশুদের পাচার মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ভেতরে এবং সীমান্তের ওপারে বিশেষ করে ভারতে ছেলে, মেয়ে এবং ট্রান্সজেন্ডারদের যৌনকর্মে নিয়োজিত করা হয়। অপরাধের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে না পারা এবং বিচারহীনতার কারণে এমন অপরাধ চলতে থাকে।”
ভারতে পাচারের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা প্রশ্ন করা হলেও তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেননি।
মুলালি বলেন, অভিবাসী কর্মীরা দেশে অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড়ো ভূমিকা রাখেন। তবে নারী অভিবাসন কর্মীরা যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন প্রকার ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হন।
তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গৃহকর্মী হিসাবে নিয়োজিত নারী অভিবাসী কর্মীদের ধর্ষণসহ শারীরিক ও যৌন নির্যাতন মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের ওপর এই নির্যাতনের কোনো প্রতিকার অথবা ক্ষতিপূরণ পান না তাঁরা। বিদেশ ফেরত নারীরা সমাজে কলঙ্ক ও বৈষম্যের শিকার হন, পাশাপাশি বিদেশ যাওয়ার খরচের দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন।”
মুলালি বলেন, রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা মানবপাচারের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। তাঁদের মালয়েশিয়া নিয়ে সেখানে বাল্য বিবাহে বাধ্য করা হয়। নারী-প্রধান পরিবারের শিশুরা পাচারের শিকার হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।”
তার মতে, কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব, সীমিত শিক্ষার সুযোগ, চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে কক্সবাজার ও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পাচারের ঝুঁকি বাড়ছে।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও মানবপাচারের ঝুঁকি বেড়েছে।
ভারতে পাচার ঠেকাতে ‘সমন্বয়ের অভাব’
মানবপাচার নিয়ে কাজ করা অন্যতম পুরানো বেসরকারি সংগঠন রাইটস যশোর। সংগঠনটি ২০০২-০৩ সাল থেকে ভারতে পাচার হওয়া নারী-শিশুদের পুনর্বাসনে সংশ্লিষ্ট বলে বেনারকে জানান নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে বছরে কমপক্ষে দুই হাজার নারী ও মেয়ে শিশু পাচার হয় এবং পাচারের শিকারদের মুম্বাইসহ দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়।
এ পর্যন্ত পাচারের শিকার প্রায় ১৭০০ নারী-শিশুকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছে রাইটস যশোর।
পাচার হওয়া নারীদের অধিকাংশের বয়স ১৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে জানান তিনি।
ভারতের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা জাস্টিস এন্ড কেয়ারের কয়েক বছর আগের এক সমীক্ষায় বলা হয়, গত এক দশকে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিশু ও নারী অবৈধ পথে পাচার হয়ে ভারতে এসেছে। এদের বয়স ১২ বছর থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
দালাল বা এজেন্টদের মাধ্যমে ভারতে আসার পর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাঙ্গালুরু ও মুম্বাইর মতো বড়ো শহরগুলোতে। অনেককে যৌন পল্লীতে বিক্রি করেও দেওয়া হয়। লাগানো হয় দাস শ্রমিকের কাজে।
এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ যৌনপল্লি মুম্বাইয়ের কামাথিপুরা যৌনপল্লিসহ অন্যান্য যৌনপল্লিতে কয়েক হাজার বাংলাদেশি নারী রয়েছেন।
বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের (মাসুম) সম্পাদক কিরীটি রায় বেনারকে বলেন,“বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত দিয়ে যে পাচারের বৃহত্তম চক্র কাজ করে তা ইউনিসেফের প্রতিবেদনে একাধিকবার বলা হয়েছে।”
“পাচার ঠেকানোর লক্ষ্যে ভারত ও বাংলাদেশ ২০১৫ সালে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এমনকি টাস্কফোর্সও তৈরি করেছে। কিন্তু দুই দেশের সরকারের সমন্বয়ের অভাব ও নানা জটিলতার কারণে পাচার কমা দূরের কথা, বেড়েই চলছে,” বেনারকে বলেন পাচার রোধ সংক্রান্ত আন্দোলনে যুক্ত সমাজকর্মী সুব্রত চৌধুরী।
কিরীটি রায় বলেন, পাচার মোকাবিলার নামে বাংলাদেশি নারী ও শিশুদের গ্রেপ্তার করার পর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এটা যে আইনবিরুদ্ধ তা জানিয়ে মাসুম বিভিন্ন সময়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অভিযোগ করেছে।
কলকাতার আইনজীবী অসিত ব্যানার্জি বেনারকে বলেন, নির্যাতিত নারীরা সহজে পুলিশের কাছে মুখ খুলতে চান না তাদের নাগরিকত্বের পরিচয় জটিলতার কারণে। ফলে শেষ পর্যন্ত এদের জেলেই থাকতে হয়। অথচ আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, পাচার হয়ে আসা নারী ও শিশুদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।