সাফারি পার্কে ২৩ দিনে নয়টি জেব্রার রহস্যজনক মৃত্যু
2022.01.25
ঢাকা
গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে চলতি মাসে নয়টি জেব্রা অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছে। মৃত জেব্রাগুলোর জন্ম সাফারি পার্কেই, বয়স দুই থেকে তিন বছর।
নয় জেব্রার রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়টি বেনারের কাছে নিশ্চিত করেছেন বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের পরিচালক ও বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. জাহিদুল কবির।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এতো সংখ্যক জেব্রা মারা গেল। নয় জেব্রার মৃত্যুর পর বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ২২টি জেব্রা রয়েছে।
মৃত্যুর কারণ হিসাবে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, চারটি জেব্রা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে এবং বাকি পাঁচটি ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মারা গেছে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাকটেরিয়ার কারণে জেব্রার মৃত্যু সম্ভব হলেও মারামারি করে শিংবিহীন প্রাণী জেব্রার মৃত্যু গ্রহণযোগ্য নয়।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা দীপংকর বর মঙ্গলবার রাতে বেনারকে জানিয়েছেন, নয়টি জেব্রার মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বুধবারের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের পরিচালক জাহিদুল কবির মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমরা নয়টি জেব্রার মৃত্যুর কারণ বের করতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, গবেষকদের মতামত নিয়েছি। তাঁদের মতামত নিয়ে আজকে আমরা সভা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, যে মোট নয়টি জেব্রার মধ্যে চারটি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মারা গেছে। আর বাঁকি পাঁচটি বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মারা গিয়ে থাকতে পারে।”
মঙ্গলবার সকালে সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. তবিবর রহমান সাংবাদিকদের জানান, সাফারি পার্কের জেব্রা বেষ্টনীর মধ্যে জেব্রাগুলো মারা যায়।
এই মাসের শুরু থেকে জেব্রা মারা গেলেও সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গোপন রাখে। বিষয়টি জানাজানি হয় ২৪ জানুয়ারি।
কর্মকর্তারা জানান, জেব্রাগুলো হঠাৎ পড়ে গিয়ে মুখ দিয়ে ফেনা বের করতে করতে মারা যায়।
মৃত জেব্রাগুলোর দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায় সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ।
পরীক্ষার পর প্রতিষ্ঠানগুলো জানায় জেব্রাগুলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয়। তবে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মিলেছে।
পার্কগুলোর ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে
ময়মনসিংহ অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি বিভাগের ডিন ড. এ.কে. ফজলুল হক ভূঁইয়া মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “মারামারি করে জেব্রা মারা যাওয়ার কথা নয়। প্রাণীরা মারামারি করে সেটি ঠিক। কিন্তু তারা মারামারি করে মরে যাবে-আমার মনে হয় এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়। তাহলে তো কোনো জেব্রা আর বেঁচে থাকত না।”
তিনি বলেন, “বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে আমাদের দেশের চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কগুলোর ব্যবস্থাপনা অনেক পিছিয়ে। আমাদের এখানে এগুলোর ব্যবস্থাপনা উন্নত করা দরকার।”
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক আবুল হাশেম সাফারি পার্কের ব্যবস্থাপনার জন্য আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
তিনি মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, জেব্রা মূলত আফ্রিকার দেশগুলোতে রয়েছে। জেব্রা যেসব গাছ, লতাপাতা খায় সেগুলো বাংলাদেশে নেই। সেকারণে বাংলাদেশে জেব্রা নেই।
অধ্যাপক হাশেম বলেন, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে যেসব জেব্রা আছে সেগুলো আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। এগুলো গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ছেড়ে দেয়ার পর সেগুলো বাংলাদেশের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং বংশ বিস্তার করেছে।
তিনি বলেন, “এভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নয়টি জেব্রার মৃত্যু সত্যিই দুঃখজনক এবং অগ্রহণযোগ্য।”
অধ্যাপক হাশেম বলেন, “কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে নয়টি জেব্রা মারা গেছে সেগুলো বাংলাদেশে আনা জেব্রাগুলোর বাচ্চা। বয়সও দুই-তিন বছরের বেশি।”
তিনি বলেন, “এর অর্থ হলো, এই সকল মারা যাওয়া জেব্রাগুলোও আমাদের এখানকার লতাপাতা, খাবারের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।”
অধ্যাপক হাশেম বলেন, “যেহেতু এই জেব্রাগুলো একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে থাকে সেহেতু সেখানকার পানি অথবা খাদ্য অথবা কোনো প্রতিবেশগত কারণে সমস্যা হতে পারে।”
তিনি বলেন, “ব্যাকটেরিয়ার কারণে জেব্রার মৃত্যু হতে পারে। তবে প্রকৃত কারণ বের করতে আরও গবেষণা দরকার বলে আমি মনে করি।”
অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. জাহিদুল কবির বেনারকে বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি মনে জেব্রার আবাসস্থল পরিবর্তন করতে হবে, সাফারি পার্কের নালার পানি পরিবর্তন করতে হবে, মাটি উলটপালট করতে হবে, সব জেব্রাকে টিকার আওতায় আনতে হবে।
ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে মৃত্যু: আইসিডিডিআরবি
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা দীপংকর বর বেনারকে জানান, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে নয় জেব্রার মৃত্যুর বিষয়টি মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের সভায় আলোচিত হয়।
তিনি বলেন, “মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, মন্ত্রণালয় মৃত্যুর কারণ বের করতে একটি তদন্ত কমিটি করা হবে। সেখানে যদি কারও কোন গাফিলতি থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
দীপংকর বলেন, “নয় জেব্রার মৃত্যুর কারণ হিসাবে আইসিডিডিআরবি জানিয়েছে, ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে জেব্রাগুলোর মৃত্যু হয়েছে। তবে কোন ধরণের ইনফ্লুয়েঞ্জা সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নয়।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের দুটি ল্যাব এবং আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠানে ইনফ্লুয়েঞ্জার ধরণ চিহ্নিত করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে মৃত জেব্রার নমুনা বিদেশে পাঠানো হবে।”