বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ১১ জেব্রার মৃত্যু নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনেও ধোঁয়াশা

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.02.23
ঢাকা
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ১১ জেব্রার মৃত্যু নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনেও ধোঁয়াশা গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে কয়েকটি জেব্রা। ৭ জানুয়ারি ২০২১।
[বেনারনিউজ]

গত মাসে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ১১ জেব্রার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটি বুধবার জানিয়েছে, নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কিছু জেব্রা মারা গেছে মর্মে পার্ক কর্তৃপক্ষের দাবি সত্য নয়, বরং মারা যাওয়া তিনটি জেব্রার পেট ধারালো কিছু দিয়ে কাটা হয়েছে।

জেব্রার পেট কাটার বিষয়টি সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে বলে বেনারকে জানান পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত কমিটির প্রধান সঞ্জয় কুমার ভৌমিক।

দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে পরিবেশ মন্ত্রণালয় মামলা দায়ের করবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয়। একইসাথে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও রুজু করা হবে বলে তিনি জানান।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, কমিটি মনে করে ১১টি জেব্রার সবগুলোই ঘাস থেকে আসা অতিরিক্ত নাইট্রেট ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে মারা গেছে।

তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কমিটির এই প্রতিবেদনটি স্ববিরোধী। কারণ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে মারা গেলে জেব্রাগুলোর পেট ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটা হলো কেন। বিষয়টি আরও তদন্তের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন তাঁরা।

গত জানুয়ারি মাসে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে হঠাৎ করেই দফায় দফায় এক মাসের মধ্যে ১১টি জেব্রা মারা যায়। প্রথমে জেব্রাগুলোর মৃত্যুর খবর চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ।

মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন পর বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে চলে আসলে সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায় কিছু জেব্রা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে এবং চারটি জেব্রা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মারা গেছে।

তবে শিংবিহীন নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় প্রাণী জেব্রা কীভাবে মারামারি করে মারা গেলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সঞ্জয় কুমার ভৌমিককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।

গাজীপুরের শ্রীপুর আসনের সাংসদ ইকবাল হোসেন সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন যে, জেব্রাগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। ২ ফেব্রুয়ারি তিনি বেনারকে বলেন, সাফারি পার্কের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত এবং অন্যকে ফাঁসাতে জেব্রাগুলোকে হত্যা করা হয়েছে।

ইকবাল হোসেন আরও জানান, প্রয়োজনে তিনি সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করবেন।

কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার অভিযোগ

কয়েক দফা সভার পর ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।

মঙ্গলবার পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সভাপতিত্বে এক জরুরি সভায় সিদ্ধান্ত হয়, “কমিটির মতামত অনুযায়ী দায়ীদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিতপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ফৌজদারি মামলা দায়ের করবে মন্ত্রণালয়।”

মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “প্রথম দিকের তিনটি জেব্রার মৃত্যু ধামাচাপা দেওয়া এবং আঘাতজনিত কারণ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে উক্ত মৃত তিনটি জেব্রার পেট ধারালো কিছু দিয়ে কাটা হয়েছে মর্মে কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে।”

বলা হয়, “কে বা কারা উক্ত মৃত তিনটি জেব্রার পেট কেটেছে তা উদঘাটন করার জন্য নিবিড় তদন্তের প্রয়োজন।”

কর্তব্যরত ভেটেরিনারি অফিসারের চাহিদা মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সাফারি পার্ক মেডিক্যাল বোর্ডের সভা আহবান করবেন মর্মে বিধান থাকা সত্ত্বেও জেব্রাগুলোর অস্বাভাবিক মৃত্যুতে মেডিক্যাল বোর্ডের সভা আহ্বান করা হয়নি উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি “সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার শামিল।”

বলা হয়, “কোন প্রাণীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জিডি করার প্রচলন থাকলেও এক্ষেত্রে থানায় কোনো জিডি করা হয়নি, যা রহস্যজনক।”

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব গত ২২ জানুয়ারি সাফারি পার্ক পরিদর্শন করেন। সেদিন পর্যন্ত আটটি জেব্রা মারা গেলেও প্রকল্প পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ভেটেরিনারি কর্মকর্তা বা কর্মরত অন্য কেউ জেব্রার মৃত্যুর ঘটনাটি সচিবকে অবহিত করেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

“এতে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথম থেকেই জেব্রা মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক, অগ্রহণযোগ্য ও সরকারি কর্মচারী আচরণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, যা দায়িত্ব অবহেলার শামিল,” উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ঘাস থেকে সংক্রমণের ব্যাখ্যা

তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু হাদী নূর আলী খান বুধবার বেনারকে বলেন, সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষ দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদারদের মাধ্যমে ঘাস কিনে সেগুলো জেব্রাগুলোকে খাওয়ায়।

তিনি বলেন, নিয়মানুযায়ী জেব্রাগুলোকে ৪৫ দিন বয়সী ঘাস খাওয়ানো উচিত। এর কারণ ঘাসের বয়স ৪৫ দিন হলে ঘাসে নাইট্রেটের পরিমাণ অনেক কম থাকে। কিন্তু মারা যাওয়া জেব্রাগুলোকে ৩০ দিনের ঘাস খাওয়ানো হয়েছে। ফলে জেব্রাগুলোর শরীরে বেশি পরিমাণে নাইট্রেট গেছে।

অধ্যাপক আবু হাদী বলেন, “নাইট্রেট একা জেব্রাকে মারতে পারে না। কিন্তু শরীরে নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে গেলে অক্সিজেনে পরিমাণ কমে যায় এবং জেব্রাগুলো মারা যায়। এক কথায় ঘাস থেকে শরীরে যাওয়া অতিরিক্ত নাইট্রেটের প্রভাব ও মিশ্র ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে জেব্রাগুলো মারা গেছে।”

ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে মারা গেলে তিনটি জেব্রার পেট কাটা হলো কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা এই বিষয়টি বের করতে পারিনি। আবার কে পেট কেটেছে সেটিও বের করতে পারিনি।”

প্রতিবেদন অগ্রহণযোগ্য

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ. কে. এম. শহিদুল হক বুধবার বেনারকে বলেন, “তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন একদিকে বলছে ১১টি জেব্রাই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে মারা গেছে। আবার একই প্রতিবেদনে তাঁরা বলছেন যে, তিনটি জেব্রার পেট ধারালো কিছু দিয়ে কাটা হয়েছে। যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে মারা যায়, তাহলে তো ধারালো কিছু দিয়ে পেট কাটার কারণ নেই। কমিটির এই প্রতিবেদন স্ববিরোধী।”

তিনি বলেন, কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন দেখে মনে হচ্ছে, কাজটি যেনতেনভাবে করা হয়েছে।

শহিদুল হক বলেন, “আমি মনে করি, যেহেতু প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে মৃত্যুর কারণ বের করতে পারেনি এবং এমনকি কারা পেট কেটেছে সেটি বের করতে পারেনি, সেহেতু উচ্চ পর্যায়ের আরেকটি কমিটি করে আসল সত্য উদঘাটন করা দরকার। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।