রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: চীনের উদ্যোগে বৈঠকে বসছেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.09.17
ঢাকা
190917_meeting_Rohingya_repatriation_1000.JPG মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে দেশ ছাড়ার দুই বছর পূর্তিতে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ। ২৫ আগস্ট ২০১৯।
[রয়টার্স]

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশন চলাকালে চীনের উদ্যোগে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় বসবেন বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।

আগামী ২৫ অথবা ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে এই বৈঠক হবে বলে মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ সভায় জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

সভা শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি কর্নেল ফারুক খান বেনারকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরও বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আসিয়ান দেশগুলো সফর করে সেসব দেশের সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে আলোচনা করবেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।”

জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত মঙ্গলবারের বৈঠকে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অগ্রগতি ও দেশটির সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে বিশেষ আলোচনা করা হয়।

ফারুক খান বলেন, “চীন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য চীনের উদ্যোগে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সভার আয়োজন করেছে।”

তিনি বলেন, “পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালীন ত্রিদেশীয় এই বৈঠক হবে। বৈঠকটি সেপ্টেম্বরের ২৫ অথবা ২৬ তারিখে হতে পারে।”

পদাধিকার বলে কমিটির সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বেনারকে বলেন, “চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় এই সভা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই বৈঠক হবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের। সেখানে তিন দেশের মন্ত্রীরাই উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মিয়ানমার ও চীনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে বৈঠকের তারিখ এবং সময় নির্ধারণ করবেন।”

এর আগে ৩০ আগস্ট চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠকের কথা তাঁকে জানান।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যোগসূত্র হয়ে কাজ করতে চায় চীন। এর আগে চীনের রাজধানী বেইজিং এবং নিউইয়র্কে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। তবে কোনো মতৈক্য হয়নি।

ফারুক খান বলেন, “আমি নিজেও ওই বৈঠকে থাকব। আমরা চাই, মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করুক যাতে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় সেদেশে ফিরে যেতে পারে।”

কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারের সুপারিশ

এদিকে বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যদের আসিয়ানের বিভিন্ন রাষ্ট্র সফর করার সুপারিশ করা হয়েছে।

ফারুক খান বলেন, “আমরা আজকের বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সর্বশেষ অবস্থা আলোচনা করেছি। আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি, তাঁরা যেভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন সেভাবে হবে না। কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে।”

তিনি বলেন, “সে কারণে আমরা আজ সুপারিশ করেছি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্যরা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে আসিয়ান রাষ্ট্রসমূহ সফর করে সেদেশের সরকার ও সংসদীয় নেতাদের সাথে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করবেন।”

ফারুক খান বলেন, “ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া এবং ফিলিপাইন সফর করবেন কমিটির সদস্যরা। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে সদস্যরা এই সফর শুরু করবেন।”

কমিটির প্রস্তাব সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, “কমিটির প্রস্তাব ইতিবাচক। কারণ, তাঁরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক তৎপরতাকে ত্বরান্বিত করবেন। জনপ্রতিনিধিরা অনেকটা লবিস্টের ভূমিকা পালন করবেন। আমরা এই প্রস্তাব সমর্থন করি।”

ফারুক খান বলেন, “রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত পাঠাতে মন্ত্রণালয় তাঁদের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ বিষয়ে অবহিত করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁরা আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মাধ্যমেও মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন।”

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের উত্তর রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, নতুন পুরোনো মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে ১২ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। কক্সবাজারে জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে তাঁরা অবস্থান করছেন।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সাথে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানজনকভাবে।

এ পর্যন্ত দুই দফা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করা হলেও রাখাইনের পরিস্থিতি উন্নত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমার ফিরে যায়নি।

কমিটির সভাপতি ফারুক খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, আব্দুল মজিদ খান, হাবিবে মিল্লাত, নাহিম রাজ্জাক, কাজী নাবিল আহমেদ এবং নিজাম উদ্দিন জলিল অংশ নেন।

তবে বাংলাদেশে, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে আসন্ন ত্রিপক্ষীয় বৈঠক সম্পর্কে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করেও ঢাকাস্থা চীন ও মিয়ানমার দূতাবাসের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

‘ক্রসফায়ারে’ রোহিঙ্গাদের মৃত্যুতে জাতিসংঘের উদ্বেগ

জাতিসংঘ মানবাধিকার কর্মকর্তারা টেকনাফে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যা মামলার ছয় রোহিঙ্গা আসামির ‘ক্রসফায়ারে’ প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সোমবার জেনেভা থেকে দেয়া এক বিবৃতিতে নিহত ওই ছয় রোহিঙ্গার প্রাণহানির ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত করতে আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তারা।

তাঁরা ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের সমাবেশের পর তাঁদের চলাচলের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করায় ‘মারাত্নক শঙ্কা’ প্রকাশ করেছেন।

বিবৃতিতে বলা হয়, বৈষম্যমূলকভাবে রোহিঙ্গাদের চলাচলের ওপর বাধা আরোপ করা হয়েছে। পাশপাশি তাঁরা বলেন, টেলিযোগাযোগের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ আরও মারাত্নক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার জন্ম দিতে পারে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।